খরা, পানিসংকট আর উপেক্ষা: হুমকিতে উত্তরাঞ্চলের খাদ্যনিরাপত্তা

পানির সংকট ও খরাকবলিত উত্তরাঞ্চলে ফাটল ধরা মাঠছবি: প্রথম আলো

শেষ শ্রাবণের উত্তপ্ত রোদে উত্তরাঞ্চলের নওগাঁ জেলার সরু আঞ্চলিক সড়ক ধরে পৌঁছালাম সাপাহারের লক্ষ্মীপুর গ্রামে। আমনের বীজ বোনার জন্য এখন বৃষ্টি দরকার। গুমোট আবহাওয়া দেখে মনে হচ্ছিল বৃষ্টি হবে। কিন্তু সেই আশা বৃথা। আমের মৌসুম তখনো শেষ হয়নি। গ্রামের মুখেই দেখা বিজিয়ান মুর্মুর সঙ্গে। ৫৬ ছুঁই ছুঁই এই সাঁওতাল নারী বলেন, ‘গরম বিশি ল্যাগছে এখন। আগে পাখা হাঁকে হাঁকে ঘুমে য্যাতাম। এখন তো ফ্যান অ্যাসেছে। কিন্তু গরম কমেইনি। আগের থেকে বৃষ্টিও মুনে হয় কইমেই গিছে।’

লক্ষ্মীপুর গ্রাম এবং আশপাশের এলাকায় একসময় প্রচুর ধানের আবাদ হতো। বিজিয়ান মুর্মুও ছোটবেলায় এ অঞ্চলের চাষাবাদ দেখেছেন, পরিবারের কাজে সহায়তাও করেছেন। কিন্তু পুরো সাপাহারের রুক্ষ মাটিতে এখন আমগাছের রাজত্ব। বিজিয়ানের কথা, ‘মাটির নিচে জল নাই। বৃষ্টিও কম, ধানে তো লাভ কইমে গেছে। তাই আম আসছে।’

আরও পড়ুন

আম এ এলাকার মানুষের অনেকের সংসারে হাল ফিরিয়েছে। কিন্তু বিজিয়ানের মতো প্রান্তিক মানুষ, যাঁদের জীবনটাই ধান-সবজির ওপর নির্ভর করে, তাঁদের কষ্ট কমেনি। এখানে প্রধান সমস্যা পানির।

উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। শুকনো মৌসুমে খাওয়ার পানি আর সেচের পানির জন্য হাহাকার লেগে থাকে, বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলে। সরকারের তথ্য বলছে, এ অঞ্চলে বৃষ্টিও কমছে দিন দিন। আর সঙ্গে প্রচণ্ড গরম। এই জুনে সারা দেশেই ২০ শতাংশের মতো বৃষ্টি কম হয়েছে। উত্তরাঞ্চলে তা আরও কম। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাড়তে থাকা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্যই এসব পরিবর্তন। বিজিয়ানদের কাছে এসব শব্দ একেবারে অপরিচিত। কিন্তু ‘কিছু একটা ঝামেলা চইলছে’ বলে মনে করেন তিনি। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া, কম বৃষ্টি আর বাড়তে থাকা গরম—এই ত্রয়ীর চাপে এখন উত্তরের মানুষ।

নওগাঁর সাপাহার, নিয়ামতপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, গোমস্তাপুর, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোরের বিভিন্ন এলাকায় কয়েক দিন ঘুরে দেখা গেছে—এই চাপ দিন দিন আরও বাড়ছে। এসব এলাকার কৃষিজীবী, শ্রমজীবী এবং নানা পেশার মানুষ পাল্টে যাওয়া প্রকৃতির নানা গল্প বলেছেন। তাঁরা শোনালেন বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের লড়াইয়ের কথা।

আরও পড়ুন
উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। শুকনো মৌসুমে খাওয়ার পানি আর সেচের পানির জন্য হাহাকার লেগে থাকে, বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলে। সরকারের তথ্য বলছে, এ অঞ্চলে বৃষ্টিও কমছে দিন দিন। আর সঙ্গে প্রচণ্ড গরম।

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত সামলাতে নানা প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু দেশের শস্যভান্ডার এই উত্তর জনপদ এখনো অভিঘাত মোকাবিলায় প্রস্তুত নয় বলেই মনে করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান। তিনি এ অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে কয়েক দশক ধরে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং এর অভিযোজনের প্রসঙ্গ এলে উপকূলীয় এলাকার কথাই আগে আসে। উত্তরাঞ্চলের বৈচিত্র্যময় পরিবেশ, এখানকার ভিন্নতা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে জলবায়ুর অভিযোজনের চেষ্টা খুব কমই চোখে পড়ে। উত্তর জনপদ মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয়। খাবারের ওপর যদি আঘাত আসে, তবে তো পুরো দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, বিশেষত রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর বিস্তীর্ণ বরেন্দ্র এলাকা ইতিমধ্যেই খরা ও পানিসংকটের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে পরিচিত। ২০২৫ সালে গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘রিভিজিটিং দ্য ড্রাউট–ফুড ইনসিকিউরিটি নেক্সাস: আ সোশ্যাল–ইকোলজিক্যাল সিস্টেমস পারস্পেকটিভ’ শীর্ষক গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের চাপ যদি আরও বেড়ে যায় এবং পানি ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা দেখা দেয়, তাহলে এ অঞ্চলের খাদ্যনিরাপত্তা অর্ধেকের বেশি কমে যেতে পারে।

আরও পড়ুন
প্রচণ্ড খরায় চৌচির বরেন্দ্র ভূমির কৃষিজমি। রাজশাহীর তানোর থেকে তোলা
ফাইল ছবি

নামছে ভূগর্ভস্থ পানি

তিলনা, সাপাহার সদর আর শিরন্টি—সাপাহারের এ তিনটি ইউনিয়ন চরম খরাপ্রবণ। তিলনা ইউনিয়নে আজ থেকে বছর দশেক আগেও মোটামুটি ৩০ ফুট মাটি খুঁড়ে পানি পাওয়া যেত। টিউবওয়েল বসানো ততটা কঠিন ছিল না। এখন ৪০ থেকে ৫০ ফুটে গিয়ে পাওয়া যায় পানির সন্ধান।

অন্তত ২৬ বছর ধরে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত তিলনার চন্দুরার কৃষক রফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা হচ্ছিল খেতের পাশে বসে। তিনি বলছিলেন, ‘এখন ৩০ ফুট নিচে গেলে পাওয়া যায় লাল বালু। সেখানে পানি নেই। মাটি মরে গেছে। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে পরিস্থিতি যা হয়, তা আর কবার নয়।’ এই কৃষক বলেন, পানির কষ্ট দিন দিন বাড়ছে এসব এলাকায়। আর তাতে গভীর নলকূপও অকেজো হয়ে পড়ে মাঝেমধ্যে।

উপজেলায় মোট ৩৬০টি গভীর নলকূপ আছে। এর মধ্যে ফি বছর একাধিক নলকূপ নষ্ট হয়ে যায় বলে জানান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাপলা খাতুন। তিনি বলেন, ‘দেশের যেকোনো এলাকার চেয়ে এখানে কৃষির খরচ অনেক বেশি। প্রধান সমস্যা পানি। শুধু কৃষিজমিই নয়, অন্তত ৩০ শতাংশ বসতবাড়ির মানুষ চরম পানির কষ্টে থাকে।’

২০২২ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৪৬৫টি অগভীর ভূগর্ভস্থ পানির পর্যবেক্ষণ কূপের ৪০ বছরের উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়। গবেষণায় শুষ্ক মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার ও অবস্থান বিশ্লেষণে দেখা যায়, পানির ব্যাপক ব্যবহারের কারণে দেশের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে এক থেকে তিন মিটার পর্যন্ত পানির স্তর নেমে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত সামলাতে নানা প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু দেশের শস্যভান্ডার এই উত্তর জনপদ এখনো অভিঘাত মোকাবিলায় প্রস্তুত নয় বলেই মনে করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান।

২০২২ সালে খ্যাতনামা সায়েন্স সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘দ্য বেঙ্গল ওয়াটার মেশিন: কোয়ান্টিফায়েড ফ্রেশওয়াটার ক্যাপচার ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় পানির পুনর্ভরণের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি কূপের পানির স্তর নামছে। পুনর্ভরণ প্রায় হচ্ছেই না। ১৯৭০ থেকে ২০২০ সাল—এ সময়ের পানির স্তর ও পুনর্ভরণের চিত্র উঠে আসে এই গবেষণায়।

রাজশাহীর গোদাগাড়ীর পানিস্তর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১৯৮০-এর দশকে শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর নামলেও বর্ষায় পুনর্ভরণ হতো ১৬ থেকে ১৮ মিটার। কিন্তু ২০১০ সালের পর পুনর্ভরণ ১৬ মিটারের বেশি হচ্ছে না। নাচোল উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানায়, উপজেলায় গভীর নলকূপ ছিল ২৫০টি। গত বছর বোরোর মৌসুমে ৫৫টিই বন্ধ ছিল। সেচ ছিল না, ফলে সেচনির্ভর চাষাবাদে প্রভাব পড়ছে। উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা সালেহ আকরাম বলেন, উপজেলায় এবার অন্তত ৩৫ শতাংশ কম বোরো উৎপাদিত হয়েছে।

বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। কিন্তু সুরক্ষিত নেই রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলও। তিস্তা অববাহিকার ১২০ কিলোমিটার এলাকায় শুকনো মৌসুমে পানির স্তর নেমে যাওয়ার চিত্র দেখেছেন পানিবিশেষজ্ঞ আনোয়ার জাহিদ। গত শুকনো মৌসুমে এ কাজ শুরু করেছে তাঁর নেতৃত্বে একটি দল। আনোয়ার জাহিদ বলেন, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় এক জটিল সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। শুকনো মৌসুমে পানির স্তর নামছে আবার বর্ষা মৌসুমে প্রবল বর্ষণে নদীভাঙন বাড়ছে।

আরও পড়ুন

উত্তরাঞ্চলে কমছে বৃষ্টি

চলতি বছর জুন মাসে দেশে ২০ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে। বাংলার বর্ষা ঋতুর প্রথম মাস আষাঢ় থাকে জুনের অর্ধেকটাজুড়ে। তারপরও বৃষ্টির এ অবস্থা। জুলাই মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হলেও উত্তরের জনপদ রংপুর বিভাগে ৩৮ মিলিমিটার বৃষ্টি কম হয়। রাজশাহীতে অবশ্য এবারের জুলাইয়ে ৩৬ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। তবে তা ধারাবাহিকভাবে হচ্ছে না; বরং দীর্ঘ মেয়াদে উত্তরে বৃষ্টি কমে যাচ্ছে।

২০১৮ সালে জার্নাল অব ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘স্প্যাশিও-টেমপোরাল ভেরিয়েশন অব প্রি-মনসুন রেইনফল অ্যান্ড রেইনি ডেইস ওভার বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় ১৯৪৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বৃষ্টির অবস্থা তুলে ধরা হয়। সেখানে দেশের পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টিপাতের ঘাটতি দেখা যায়, আর উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত লক্ষ করা যায়। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহীতে শূন্য দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টি কম হয়েছে বছরওয়ারি।

বৃষ্টির পরিমাণ কমে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির পুনর্ভরণ যেমন কমে যাচ্ছে, তেমনি ভূ–উপরিস্থিত যেসব জলাধার আছে, সেগুলোও যাচ্ছে কমে। যেমন সাপাহারের জবই বিল উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার দূরে শিরন্টি, গোয়ালা, আইহাই ও পাতাড়ী—এই চার ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। একসময় এ বিল ছিল কৃষি সেচের বড় উৎস। এখন এ বিলে, বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে যথেষ্ট পানি থাকে না বলে এর ওপর নির্ভরতা কমছে—এমনটাই বলছিলেন গোয়ালার কৃষক আবদুস সোবহান। তাঁর কথা, ‘বিলে পানি কমে আসায় শুকনার সময় নলকূপের ওপরই ভরসা।’

আরও পড়ুন
২০২৫ সালে গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘রিভিজিটিং দ্য ড্রাউট–ফুড ইনসিকিউরিটি নেক্সাস: আ সোশ্যাল–ইকোলজিক্যাল সিস্টেমস পারস্পেকটিভ’ শীর্ষক গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের চাপ যদি আরও বেড়ে যায় এবং পানি ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা দেখা দেয়, তাহলে উত্তরাঞ্চলের খাদ্যনিরাপত্তা অর্ধেকের বেশি কমে যেতে পারে।

উত্তাপের প্রভাব কৃষিতে

গত শতকের আশির দশকে কৃষিতে সবুজ বিপ্লবের রমরমা সময় ছিল। সে সময় ফসলের শত্রু ছিল পোকা। এসব পোকা মারতে কীটনাশকের ব্যবহার বেড়ে যায়। এর ফলও মেলে। শুধু কীটনাশকের ব্যবহার নয়, সেচযন্ত্রের সম্প্রসারণ ওই সময় বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু এসব পন্থা খুব বেশি টেকসই হয়নি। অচিরেই এসবের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়।

আশির দশকে উত্তরাঞ্চলে মাজরা, পামরি ও বাদামি ঘাসফড়িংয়ের উৎপাত বেশি ছিল। কিন্তু এখন ৮০টির বেশি পোকার মোকাবিলা করতে হচ্ছে উত্তরের কৃষকদের। এমন তথ্য জানান চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (হর্টিকালচার) এ কে এম মনজুরে মাওলা। তিনি বলেন, উত্তরের জনপদে বৃষ্টি কমে যাওয়ার কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে দিন দিন। এর প্রভাব পড়েছে কৃষিতেও। উষ্ণতা পোকার সংখ্যা বাড়িয়ে তুলেছে। অবশ্য এর সঙ্গে কৃষিতে অপ্রয়োজনীয় মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগেরও সম্পর্ক রয়েছে।

দেশের মোট ধানের প্রায় ৬০ শতাংশ বোরো। উত্তরের জনপদে, বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রধান ফসল এটি। মার্চ থেকেই দেশে গরম পড়তে থাকে। এ সময় গড় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকলে বোরোতে পরাগায়ন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু উত্তরাঞ্চলে সে সময় তাপমাত্রা বেশির ভাগ সময়ই ৩৫ ডিগ্রির বেশি থাকে। এর অনিবার্য ফল হিসেবে ধানে চিটা ধরে। চিটা রোধে ধানের চারা জলমগ্ন রাখা অপরিহার্য। এ জন্য প্রয়োজন সেচ। কিন্তু উত্তপ্ত উত্তরাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিম্নগামী। দিশেহারা কৃষক তখন বাধ্য হয়েই সেচের পরিমাণ কমিয়ে দেন।

আরও পড়ুন
খরাকবলিত খেত। সেখানে সূর্যের প্রচণ্ড তাপ থেকে রক্ষা পেতে ছাতা মাথায় কৃষক। তানোর, রাজশাহী
ফাইল ছবি

দেখা গেছে, ঢাকাসহ দেশের আট বিভাগেই বর্ষা মৌসুমে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বেড়েছে। এর মধ্যে খরাপ্রবণ রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা প্রতি দশকে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে—শূন্য দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে। বৃষ্টিবহুল সিলেটেও একই মাত্রায় তাপ বেড়েছে। ঢাকা, রংপুর ও চট্টগ্রাম বিভাগে প্রতি দশকে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে শূন্য দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে। ‘বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল জলবায়ু: আবহাওয়ার পর্যবেক্ষণে ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সালের প্রবণতা এবং পরিবর্তন’ শীর্ষক গবেষণায় উত্তরের এই অধিক তাপের চিত্র উঠে এসেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ এই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ গবেষণা হয়েছে ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত।

দেশে আবহাওয়া অধিদপ্তরের যতগুলো কেন্দ্র আছে, সেখান থেকে এই গবেষণার তথ্য-উপাত্ত নেওয়া হয়। সূর্যালোক (দিনে সূর্যের আলো যতক্ষণ থাকে) সবচেয়ে বেশি পরিমাণ কমেছে শীতকালে। এর মধ্যে গত ৪০ বছরে রংপুর বিভাগে সূর্যালোক সবচেয়ে বেশি কমেছে। এরপর সূর্যালোক কমেছে ঢাকা, ময়মনসিংহ ও রাজশাহী বিভাগে।

তাপ, পানির ঘাটতিতে দিশেহারা উত্তর জনপদের কৃষক। ২০২২ সালের মার্চ মাসে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নিমঘাটু গ্রামের দুই সাঁওতাল কৃষক সেচের পানি না পেয়ে আত্মহত্যা করেন বলে জানিয়েছিল পুলিশ।

আরও পড়ুন
দেশের মোট ধানের প্রায় ৬০ শতাংশ বোরো। উত্তরের জনপদে, বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রধান ফসল এটি। মার্চ থেকেই দেশে গরম পড়তে থাকে। এ সময় গড় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকলে বোরোতে পরাগায়ন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু উত্তরাঞ্চলে সে সময় তাপমাত্রা বেশির ভাগ সময়ই ৩৫ ডিগ্রির বেশি থাকে। এর অনিবার্য ফল হিসেবে ধানে চিটা ধরে। চিটা রোধে ধানের চারা জলমগ্ন রাখা অপরিহার্য। এ জন্য প্রয়োজন সেচ। কিন্তু উত্তপ্ত উত্তরাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিম্নগামী। দিশেহারা কৃষক তখন বাধ্য হয়েই সেচের পরিমাণ কমিয়ে দেন।

বোরো চাষে লাগাম

বোরোর জন্য ভূগর্ভস্থ পানির অবস্থা জেরবার। বছর দুয়েক ধরে বোরো চাষে লাগাম টানার কাজ শুরু হয়েছে। তাতে স্থানীয়ভাবে কিছুটা ফলও মিলছে। চলতি বছর নাচোলে দুই হাজার হেক্টরের বেশি জমি বোরো ধানের এলাকা কমিয়ে আনা হয় বলে জানান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সালেহ আকরাম। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৭ হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়। আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৯০০ হেক্টর। এতে বোরোর আবাদ অন্তত ৩৫ শতাংশ কমে গেছে। কিন্তু মসুর ও ভুট্টার চাষ বেড়েছে।

আরও পড়ুন

খাদ্য পরিস্থিতি ঝুঁকিতে

সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সাময়িকীতে সম্প্রতি প্রকাশিত তিনজনের এক গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো ইউনিভার্সিটির পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন বিভাগের শিক্ষক মো. সারওয়ার হোসেন। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, বর্তমানে যেভাবে কৃষি চলছে, তা যদি অব্যাহত থাকে, তবে কিছু সময়ের জন্য খাদ্য উৎপাদন বাড়তে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার। একপর্যায়ে পানিসম্পদ ফুরিয়ে যেতে শুরু করবে, যা দীর্ঘমেয়াদে খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলবে।

গবেষকেরা ভবিষ্যতের জন্য বিভিন্ন পরিস্থিতি পরীক্ষা করেছেন। দেখা গেছে, যদি তাপমাত্রা ৩.৫ থেকে ৫.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যায় এবং একই সময়ে উজানে পানি প্রত্যাহার বা বাঁধ নির্মাণের কারণে নদীর প্রবাহ কমে যায়, তাহলে উত্তরাঞ্চলে খাদ্যনিরাপত্তা প্রায় ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।

আরও উদ্বেগজনক হলো কিছু ‘টিপিং পয়েন্ট’ বা সংকট মুহূর্ত চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন তাপমাত্রা ৩.৫ ডিগ্রির বেশি বেড়ে যাওয়া, উজানে ৩০-৫০ শতাংশ পানি প্রত্যাহার, কৃষি ভর্তুকি অর্ধেক বা পুরোপুরি কেটে দেওয়া, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা। সারওয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এই পরিস্থিতিগুলো একসঙ্গে ঘটলে খাদ্য উৎপাদন মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়বে এবং মানুষ চরম খাদ্যসংকটে পড়বে।

গবেষকেরা বলছেন, খাদ্যনিরাপত্তাকে কেবল ধান-গমের উৎপাদন দিয়ে মাপা যাবে না। পানি ব্যবস্থাপনা, কৃষি ভর্তুকি, জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা—সবকিছু মিলে একটি জটিল সম্পর্ক তৈরি করে। এই সম্পর্ককে না বুঝলে টেকসই খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখনই যদি সমন্বিত পরিকল্পনা নেওয়া যায়, তবে বড় ধরনের সংকট এড়ানো সম্ভব। আর তা না হলে কয়েক দশকের মধ্যে উত্তরাঞ্চল একটি বড় মানবিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে।

আরও পড়ুন
তাপ, পানির ঘাটতিতে দিশেহারা উত্তর জনপদের কৃষক। ২০২২ সালের মার্চ মাসে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নিমঘাটু গ্রামের দুই সাঁওতাল কৃষক সেচের পানি না পেয়ে আত্মহত্যা করেন বলে জানিয়েছিল পুলিশ।

জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনে উপেক্ষিত উত্তর

জলবায়ু পরিবর্তন বা এর প্রভাবসংক্রান্ত আলোচনা উঠলেই উপকূল বা দক্ষিণের কথাই উঠে আসে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক শরমিন্দ নিলোর্মী। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘উত্তরাঞ্চলে বিকল্প চাষ এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বিস্তার ঘটিয়ে মঙ্গা পরিস্থিতির উন্নতি করে আমরা মনে করছি সবকিছু করে ফেলেছি। অভিযোজনের জন্য তেমন তৎপরতা নেই বললেই চলে।’

বরেন্দ্র এলাকার কৃষিজমিতে চলছে সেচ। সম্প্রতি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চৈতন্যপুর গ্রাম থেকে তোলা
ছবি: আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

‘ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট’ নামের একটি প্রকল্প চলছে দেশের ২৭ উপজেলায়। এর মধ্যে ১৩টিই দক্ষিণের, ৭টি উত্তরাঞ্চলের। উত্তরাঞ্চলের প্রকল্পটি চলছে দিনাজপুরের বিরল ও কাহারোল, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর, ভোলারহাট, পঞ্চগড়ের সদর ও দেবীগঞ্জ এবং ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলায়। উত্তরের চরম খরাপ্রবণ এবং উষ্ণতার শিকার সাপাহার, নাচোল, গোমস্তাপুর, শিবগঞ্জ, নিয়ামতপুরসহ অনেক উপজেলা এ কার্যক্রমের বাইরে। উত্তরের সাত উপজেলায় এ কাজ দেখভাল করেন কৃষিবিদ রাশেদ ইফতেখার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সেচযন্ত্র চালানোর জন্য সৌর প্যানেলের সহযোগিতা, কৃষিবীজ উৎপাদন কেন্দ্র, শেড ইত্যাদি নানা সেবা চালু রয়েছে।

উত্তরাঞ্চল বলতে একক অভিন্ন প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কোনো এলাকা বোঝায় না। এর প্রকৃতির মধ্যেও ভিন্নতা আছে। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর ও নওগাঁর বিস্তীর্ণ অঞ্চল লাল মাটির বরেন্দ্র এলাকা। আবার নাটোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও পাবনার বড় এলাকায় চলনবিল আছে। এর বাইরে সর্ব উত্তরের দিনাজপুর, রংপুর, গাইবান্ধার একটি ভিন্ন প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য আছে। তবে প্রতিটি এলাকাই তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং পানির স্তর নেমে যাওয়ার সমস্যায় জর্জরিত।

আরও পড়ুন

সরকারের জলবায়ু–সম্পর্কিত জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় (ন্যাপ) উত্তরের এই ভিন্ন ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের স্বীকৃতি এখনো যথাযথ হয়নি বলেই মনে করেন অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান। তিনি বলেন, সর্বশেষ ২০২৩ সালে ন্যাপে চলনবিলকে যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু উত্তর জনপদ জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব প্রতিনিয়ত অনুভব করছে, তা মোকাবিলায় যথাযথ ব্যবস্থা এখনো নেই।

নওগাঁর সাপাহার উপজেলার সাঁওতাল জাতিসত্তা অধ্যুষিত গ্রাম লক্ষ্মীপুর। মাটির বাড়ি এবং দেয়ালে আলপনা এসব গ্রামের বৈশিষ্ট্য
ছবি: পার্থ শঙ্কর সাহা

বাংলাদেশে বদ্বীপ পরিকল্পনায় জলবায়ুসংক্রান্ত প্রকল্পের সংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মোট ৮০টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উপকূলের জন্য সর্বোচ্চ ২৩টি, বিচ্ছিন্ন এলাকার জন্য ১৫টি, শহুরে এলাকার জন্য ১২টি, বরেন্দ্র এলাকার জন্য ৯টি, পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য ৮টি, নদী অববাহিকা এলাকার জন্য ৭টি এবং হাওর অঞ্চলের জন্য ৬টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ২০২৩–৫০ সালের জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় ১১৩টি উদ্যোগের মধ্যে মাত্র দুটি খরাপ্রবণ এলাকার জন্য রাখা হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নানা উদ্যোগের ক্ষেত্রে উপকূলীয় অঞ্চলেই মনোযোগ বেশি বলে মনে করেন পরিবেশ ও জলবায়ুবিশেষজ্ঞ হাসীব মুহাম্মদ ইরফানুল্লাহ্‌। তিনি বলেন, ‘এটা একেবারে অমূলকও নয়। কারণ, ২০০৭ সালে সিডরের পর থেকে একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়েছে উপকূল। কিন্তু এরপরও বলা যায়, উত্তরাঞ্চল এ ক্ষেত্রে প্রাধান্যের তালিকায় নেই। আমরা উত্তরাঞ্চলকে নিয়ে যথাযথভাবে কথা বলছি না। সঠিক “ফ্রেমিং” হচ্ছে না।’

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখনই যদি সমন্বিত পরিকল্পনা নেওয়া যায়, তবে বড় ধরনের সংকট এড়ানো সম্ভব। আর তা না হলে কয়েক দশকের মধ্যে উত্তরাঞ্চল একটি বড় মানবিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে।

বরেন্দ্রভূমিতে জলবায়ু ‘অ্যাডাপটেশন ক্লিনিক’

নওগাঁর সাপাহার উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামে ঢুকতেই প্রথমে পড়ে আরতি সরেনের বাড়ি। বাড়ির সামনের ছোট্ট কৃষি খেতে লাউয়ের মাচায় ঝুলে আছে ঝুমকোর মতো হলদে ফুল। মাচার নিচে ঢ্যাঁড়স, করলা, পটোল আর দুয়েক জাতের শাকের সমাহার।

এ গ্রামে ৪০ পরিবারের বাস। সবাই সাঁওতাল জাতিগোষ্ঠীর কৃষিজীবী। কারও নিজের জমি আছে, তবে বেশির ভাগ অন্যের জমিতে বর্গা খাটেন। আগের মতো ধানের আবাদ আর নেই। পানির অভাব ও প্রচণ্ড তাপ কৃষির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এ গ্রামসহ তল্লাটের অনেকেই এখন ধান বা অন্য আবাদ ছেড়ে আমের বাগান দেওয়া শুরু করেছেন। কিন্তু এ গ্রামের মানুষের মতো কৃষিজীবীদের যথেষ্ট জমি নেই। তাই এখনো কৃষিতেই বেঁচে থাকার পথ খুঁজছেন এ গ্রামের মানুষ। কিন্তু ভিন্ন পথে।

গ্রামের আরেক কৃষক গণেশ মুর্মু বলছিলেন, ‘সারা বছর যেন ফসল ফলানো যায়, সেই ব্যবস্থা হচ্ছে। যতটুকু জমি আছে, সেখানে বিকল্প চাষাবাদ শুরু হয়েছে। কিন্তুক এখানে বীজ নিজেরাই রাখছি। বিষ না দিয়ে পোকা মারছি। পানি ধরে রাখারও ব্যবস্থা হইছে।’

এ গ্রামের কৃষির বৈশিষ্ট্য হলো জৈব চাষপদ্ধতিতে এখানে চাষাবাদ হয়। কীটনাশকের ব্যবহার নেই। দ্রুত বাড়তে থাকা নতুন নতুন চারা এখানে লাগানোর ব্যবস্থা আছে। কোন মাটিতে কোন সময় ফসল করতে হবে, তা পরীক্ষা করে গ্রামের মানুষকে জানানো হয়। পানির অভাবের এ গ্রামে এমনভাবে পুকুর কেটে তাতে পানির সংরক্ষণ করা হয়েছে, যাতে সারা বছর সেখানে পানি থাকে।

তাপ-খরা-ভূগর্ভস্থ পানি নেমে যাওয়ার কঠিন বাস্তবতার মুখে লক্ষ্মীপুরের মতো উত্তর জনপদের অনেক গ্রাম। এই প্রকট অবস্থা মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। সেই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে মানুষকে সহযোগিতা করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক। ব্র্যাক বলছে ‘অ্যাডাপটেশন বা অভিযোজন ক্লিনিক’।

আরও পড়ুন

গাঁয়ের প্রায় প্রতিটি বাড়ির আশপাশের কোনো জায়গা ফাঁকা নেই। সবখানেই কোনো না কোনো ফসলের খেত। সেখানে হলদে রঙের গোলাকার এক ‘ফাঁদ’ ঝুলছে। এটি ফেরোমন ট্র্যাপ বা পোকা নিয়ন্ত্রণের ফাঁদ। স্ত্রী পোকার প্রাকৃতিকভাবে নিঃসৃত ফেরোমনের মতো সুগন্ধযুক্ত এই রাসায়নিকের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পুরুষ পোকা ফাঁদে আটকা পড়ে।

চোখের সামনেই ব্র্যাকের সাপাহার অ্যাডাপটেশন ক্লিনিকের সেক্টর স্পেশালিস্ট মো. মোহিদুল ইসলাম মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করে এর ফলাফল জানিয়ে দিলেন গ্রামবাসীকে। যখন কেউ কোনো ফসল লাগাতে যান, তখনই এ সহায়তা দেওয়া হয়।

বরেন্দ্রের এ অঞ্চলে মাটির নিচে পানির স্তর নিম্নগামী। বৃষ্টির পানি ধরে রাখা একটি বড় বিকল্প। আশপাশের অনেক স্থানে পুকুরে ২ থেকে ৩ ফুট উচ্চতায় পানি থাকে। কিন্তু লক্ষ্মীপুরের পুকুরে ১০ ফুট পানি। কীভাবে তা সংরক্ষণ করা হলো?

অন্তত ২০ ফুট গভীর এ পুকুর। সেখানে বিশেষভাবে রক্ষিত পলিথিন নিচ পর্যন্ত রাখা হয়েছে যেন মাটি দ্রুত পানি শোষণ করতে না পারে।

২০২৩ সাল থেকে শুরু হয়েছে এই অভিযোজন ক্লিনিক, জানান ব্র্যাকের ক্লাইমেট চেঞ্জ প্রোগ্রামের স্পেশালিস্ট কানিজ ফাতেমা তুজ-জহুরা। তিনি বলেন, ‘পানির স্বল্পতার এ এলাকায় এমন সব ফসল গ্রামবাসীকে দেওয়া হয়েছে, যেগুলোর ফলন বেশি। এসবের বীজের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকছে। আবার যেন ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করতে না হয়, সেই বন্দোবস্তও আছে।’

সারা দেশে এমন ৩০০ গ্রামে অ্যাডাপটেশন ক্লিনিক কাজ করছে।