টানা বৃষ্টিতে রাস্তায় জমেছে হাঁটুপানি। এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন এক ব্যক্তি। বৃহস্পতিবার মিরপুরে
টানা বৃষ্টিতে রাস্তায় জমেছে হাঁটুপানি। এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন এক ব্যক্তি। বৃহস্পতিবার মিরপুরে

যানজটে ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা ১০

কে জানত, এই স্নিগ্ধতা মুহূর্তেই পরিণত হবে এক নির্মম অভিশাপে!

সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস ছিল ২৯ মে। মতিঝিল থেকে কিছু কাজ সেরে খিলক্ষেতে বাসায় ফিরছিলাম। ভেবেছিলাম, দিনের আলো ফোরানোর আগেই বাসায় পৌঁছাব। কিন্তু নিয়তি সেদিন আমার জন্য অন্য এক গল্প লিখে রেখেছিল।

দিনের শুরু থেকেই আকাশটা ছিল থমথমে। যেন এক বিশাল ক্যানভাসে কালো মেঘের আঁচড়। দুপুরের পর থেকেই ঝরতে শুরু করল বৃষ্টি। প্রথমে মন্দ লাগছিল না। ধুলোমাখা শহরের বুকে নেমে এল স্নিগ্ধতা। কিন্তু কে জানত, এই স্নিগ্ধতা মুহূর্তেই পরিণত হবে এক নির্মম অভিশাপে!

বিকেল তখন চারটা ছুঁই ছুঁই। মতিঝিল থেকে বেরিয়েই যে দৃশ্যটা চোখে পড়ল, তাতে রীতিমতো দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। এটা তো যানজট নয়, যেন মানবসৃষ্ট এক স্থির নদী! ব্যক্তিগত গাড়ি, রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, বাস—সব মিলিয়ে একাকার, নড়াচড়ার কোনো চিহ্ন নেই। শহরের প্রতিটি ধমনি যেন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল, ঢাকার সমস্ত প্রাণশক্তি এই মুহূর্তে রাস্তায় আটকে আছে।

বৃষ্টির তেজ ক্রমেই বাড়ছিল। গুঁড়ি গুঁড়ি থেকে মুহূর্তেই তা মুষলধারে রূপ নিল। প্রকৃতি যেন তার সমস্ত ক্ষোভ উগরে দিচ্ছিল আমাদের ওপর। চোখের পলকে রাস্তাগুলো পরিণত হলো নদীতে। ড্রেনেজব্যবস্থা? সে তো কবেই মুখ থুবড়ে পড়েছে এই শহরে! ময়লা, আবর্জনা, প্লাস্টিকের বোতল—ফুলেফেঁপে ওঠা পানিতে সব একাকার। গাড়ির চাকাগুলো ডুবছিল অথই পানিতে, নিজেকে মনে হচ্ছিল ডুবন্ত জাহাজের যাত্রী।

গাড়ির ভেতরে বসে আমি তখন ছটফট করছি। এসি ছেড়েও গরম লাগছিল। জানালার কাচ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছিলাম এক অদ্ভুত বিভীষিকা। মানুষগুলো ছাতা মাথায়, ভেজা পোশাকে পানি ঠেলে যেন কোনো এক অজানা গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের চোখে ছিল ক্লান্তি, বিরক্তি আর একরাশ হতাশা। গাড়ির চালকও গজগজ করছিলেন। তাঁর বিরক্তি যেন আমার ভেতরের অস্থিরতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। সামনে শুধু গাড়ির লাল বাতির ঢেউ, আর পেছনে ফিরে দেখতাম একই দৃশ্য—এক সীমাহীন স্থবিরতা।

মতিঝিল, মগবাজার—প্রতিটি মোড় যেন এক যন্ত্রণার প্রাচীর। মনে হচ্ছিল, প্রতিটি পার হওয়া মোড় জীবন থেকে একেকটি বছর কেড়ে নিচ্ছিল। হর্নের কর্কশ শব্দ, গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ আর বৃষ্টির অবিরাম শব্দ স্নায়ুতে আঘাত হানছিল। মনে হচ্ছিল, সময় যেন জমাট বেঁধে গেছে, আর আমি এক অনন্ত অপেক্ষার ফাঁদে আটকা পড়েছি।

অবশেষে আমার গাড়ি যখন খিলক্ষেতের পরিচিত গলিতে প্রবেশ করল, তখন ঘড়ির কাঁটা রাত ৯টার ঘর ছাড়িয়ে গেছে। মতিঝিল থেকে খিলক্ষেত মাত্র কয়েক কিলোমিটার পথ। অথচ পাড়ি দিতে লেগেছে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা! বিশ্বাস হচ্ছিল না, আমার চোখের সামনে এই দুঃস্বপ্নটা সত্যি হয়েছে।

রাস্তায় কাদা আর নোংরা পানির ছড়াছড়ি। গাড়ি থেকে নামতেই বুঝলাম, আমার ভেতরের জামাকাপড়ও প্রায় ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। মনে হলো, আমি যেন এক বিধ্বস্ত পথিক, কাদামাখা এক ভূতের মতো নিজের বাড়িতে প্রবেশ করলাম।

গতকালের সেই অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে, ঢাকার রাজপথ কতটা নির্মম হতে পারে। যানজট আর জলজট মিলে যে দুর্ভোগের জন্ম দেয়, তা কেবল একটি দিনের ভোগান্তি নয়, এটি যেন এই শহরের এক চলমান অভিশাপ। এই সমস্যাগুলোর সমাধান না হলে, নগরজীবন শুধু কঠিন নয়, শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে উঠবে। কবে এই বিভীষিকা থেকে মুক্তি মিলবে, কবে এই শহর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবে, তা কেবল সময়ের হাতেই বন্দী!