বাবার সঙ্গে আমার স্মারক বলতে এই মোটরসাইকেলে বসা ছবিটাই

সিলেটের মানুষ জায়গাটাকে এত দিন ‘সালুটিকর বধ্যভূমি ও গণকবর’ নামে চিনত। সেটাই এখন ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার শহীদস্মৃতি উদ্যান’। শহীদদের স্মরণে সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। আছে ৬৬ জন শহীদের স্মৃতিফলক। ৪ মার্চ এই শহীদ পরিবারের অনেকেই প্রথমবারের মতো গিয়েছিলেন শহীদস্মৃতি উদ্যানে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শহীদ সোনাওর আলীর সন্তান মঈন উদ্দীন আহমদ। তিনি শুনিয়েছেন তাঁর বাবাকে হারানোর কষ্টগাথা।

বাবার সঙ্গে ছোটবেলায়
ছবি: সংগৃহীত

বাবার মোটরসাইকেলে বসে আছি, পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন বাবা। যেন পড়ে না যাই, তাই ডান হাতটা সিটে রেখে বাঁ হাত দিয়ে মোটরসাইকেলের হাতলটা ধরে রেখেছেন। তাঁর সঙ্গে আমার স্মারক বলতে এই ছবিটাই।

ছোটবেলা থেকে শুনেছি, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সিলেটের অনেক মুক্তিকামী বাঙালির মতো আমার বাবাকেও নির্মমভাবে হত্যা করে। শহীদদের শেষ ঠিকানা হয় সালুটিকর বধ্যভূমি। জায়গাটা সিলেট ক্যাডেট কলেজের সীমানার ভেতরে হওয়ায় আগে কখনো যাওয়া হয়নি। নতুন করে সংস্কারের পর ৪ মার্চ উদ্বোধন করা হলো। সেদিনই প্রথম গেলাম। স্মৃতিস্তম্ভের পাশে কবর, শহীদদের নামফলক। সেখানে ঢুকেই কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে গেলাম। বাবার নামফলকটায় হাত বোলালাম। ভেতরটা ডুকরে উঠল।

বাবার নামফলকটায় হাত বোলালাম, ভেতরটা ডুকরে উঠল

আমার বাবা শহীদ সোনাওর আলী। কুতুব নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন তিনি। একাত্তরে ছিলেন ৩৩ কি ৩৪ বছরের এক টগবগে যুবক। দ্য ইস্টার্ন লাইফ ইনস্যুরেন্সের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক ছিলেন। ছোটবেলা থেকে বাবা ছিলেন রাজনীতিসচেতন মানুষ। ছিলেন সিলেট শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির অধিকার আন্দোলন—সব সংগ্রামেই তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিবাহিনীর অনেক সদস্য আমাদের বাড়িতে আসতেন। কেউ এসে খাওয়াদাওয়া করতেন, কেউ বিশ্রাম নিতেন। আমার ছোট ভাই শরীফ উদ্দীনের বয়স তখন মাত্র ৬ মাস। আর আমার আড়াই বছর। আমাদের দুই ভাইকে কোলে নিয়ে খুশিমনে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করতেন মা।

১৫ মে ১৯৭১। রাজাকার আর পাকিস্তানি বাহিনীর লোকজন আমাদের বাড়িতে এসে বাবাকে ধরে নিয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে তাঁকে আটকে রাখা হয়। আগস্টের শুরুর কয়েক দিন পর্যন্ত লোক মারফত বাড়িতে বাবার খবর আসত। পরিবারের লোকজন নানাভাবে চেষ্টা করছিল বাবাকে মুক্ত করতে। কিন্তু আগস্টের পর তাঁর আর কোনো বার্তা আসেনি। মুক্তিবাহিনী আর স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, আগস্টের কোনো একদিন বাবাকে হত্যা করা হয়।

বাবার সম্পর্কে যা কিছু জেনেছি, সবই আমার মা মনোয়ারা বেগম, চাচা মনোওর আলী আর নিকটজনদের মুখ থেকে শোনা। বাবার সমবয়সী যাঁরা এখনো বেঁচে আছেন, তাঁরা বাবার পরোপকার আর উদারতার কথা বলেন। শুনেছি, আমার বাবা বেশ রসিক মানুষ ছিলেন। নিজে হাসতে ও অন্যকে হাসাতে পছন্দ করতেন। বাবার সেই গুণের কিছুটা আমার মধ্যেও আছে। তবে আফসোস, বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো তাঁর আরও অনেক গুণ আমি পেতাম।

অনুলিখন: জাওয়াদুল আলম