Thank you for trying Sticky AMP!!

ধীরে চলা

২২
এরই মধ্যে সভাপতি সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন। অংশগ্রহণকারীরা সম্মেলনকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসছে কোলাহল তুলে। তারা লবিতে আসে। লবি পরিপূর্ণ মানুষে। বার্ক যান চেক বিজ্ঞানীর কাছে। ‘আমি আপনার বক্তৃতা শুনে এত আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছি যে কী বলব!’ তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে কথা খুঁজতে থাকেন, যেন বর্ণনা করার ভাষা তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। ‘আপনার এই সাক্ষ্য...আমরা তো সবকিছু কত সহজে ভুলে যাই। অবশ্য আমি আপনাকে এতটুকুন বলতে পারি যে আমি কিন্তু আপনার দেশে কী হচ্ছিল না হচ্ছিল সে ব্যাপারে খুবই সংবেদনশীল ছিলাম। আপনারা সমস্ত ইউরোপের গর্ব, ইউরোপের তো আসলে গর্ব করার বেশি কিছু নেই।’চেক বিজ্ঞানী এমন একটা ভঙ্গি করেন যেন বলতে চান, আরে না না আপনি বাড়িয়ে বলছেন...
‘না। আপত্তি করবেন না।’ বার্ক বলেন, ‘আমি ভেবেচিন্তে এটা বলছি। আপনারা, বিশেষ করে আপনার দেশের বুদ্ধিজীবীরা, কমিউনিস্ট দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সচেতনভাবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, আপনারা যে সাহস দেখিয়েছিলেন, সে সাহস তো আমাদের নেই। আপনারা স্বাধীনতার জন্য কী একটা আকুলতাই না দেখিয়েছিলেন। আপনারা স্বাধীনতার জন্য যে সাহস দেখিয়েছিলেন, তা একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে।’ এরপর তিনি তাঁর বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে একটু আটপৌরে ভাব গলায় ফুটিয়ে বলেন, ‘আর তা ছাড়া বুদাপেস্ট একটা বিশাল শহর, গুরুত্বপূর্ণ, এবং যদি আমাকে বলতে দেন, বুদাপেস্ট হলো ইউরোপীয়।’
‘আপনি বোঝাতে চাইছেন প্রাগ?’ চেক বিজ্ঞানী বলেন সংকোচের সঙ্গে।
উফ! এই যে ভূগোলের জ্ঞান। এটা বার্কের এত কম! এই ভূগোল আবারও তাকে একটা ছোট্ট ভুল করাল। তার সামনের লোকটা তো প্যাঁচঘোচ জানে না। তাই তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আমি বোঝাতে চেয়েছি প্রাগ। আমি আরও বোঝাতে চেয়েছি ক্রাকাও, সোফিয়া, সেন্ট পিটার্সবার্গ। আমার মনের মধ্যে আছে পূর্ব ইউরোপের সব শহর, যারা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে জেগে উঠেছে।’
‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বলবেন না। আমরা চাকরি হারিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের ক্যাম্পে কখনো নেয়নি।’
‘ও আমার প্রিয় বন্ধু। পূর্ব ইউরোপের সব দেশ তো পুরোটাই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প হয়ে গিয়েছিল। সত্যিকার বা কিংবা রূপকধর্মী!’
‘আর দয়া করে পূর্ব পূর্ব করবেন না। প্রাগ মোটেও পূর্ব না। এটা পশ্চিম। যেমন প্যারিস। ১৪০০ সালে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। চার্লস ইউনিভার্সিটি। পুরো রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন জ্যান হাস। লুথারের পূর্বসূরি। চার্চের সংস্কারক। বানানবিষয়ে বিশেষজ্ঞ।’
এই লোকরে কি মাছি কামড়াইছে? বার্ক বিরক্ত। যে তাকে সবার সামনে তুলে ধরল, তাকেই কিনা সে জ্ঞান দিচ্ছে? বার্ক রাগ গোপন করে গলায় উষ্ণতা ফুটিয়ে বলে, ‘আমার বন্ধু। পূর্ব থেকে এসেছে বলে লজ্জিত হবেন না। ফ্রান্সের হৃদয়ে আছে পূর্বের জন্য উষ্ণতম ভালোবাসা। আপনাদের উনিশ শতকের মাইগ্রেশনের দিকে তাকিয়ে দেখুন।’
‘আমাদের কোনো উনিশ শতকের ইমিগ্রেশন নেই।’
‘মিকি উইজের কথা স্মরণ করুন। তিনি যে ফ্রান্সকে তার দ্বিতীয় আবাস বানালেন, সে জন্য আমি গর্ববোধ করি।’
‘মিকি উইজ তো চেক নন।’ চেক বিজ্ঞানী আপত্তি জানাতেই থাকেন।
ঠিক সেই সময়ে ইমাকুলাতা দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়। সে তার ক্যামেরাম্যানদের হাত নেড়ে ইশারা দেয় ক্যামেরা ঠিক করতে। তারপর এগিয়ে যায় বার্কের দিকে, তাকে সম্বোধন করে, ‘জ্যাক আলেইঁ বার্ক!’
ক্যামেরাম্যান তার কাঁধে ক্যামেরাটা ঠিকমতো বসায়, ‘একটা মিনিট!’
ইমাকুলাতা ক্যামেরাম্যানের দিকে তাকায়, তারপর আবারও বলে, ‘জ্যাক আলেইঁ বার্ক!’
(চলবে)

২১
পতঙ্গবিদেরা গাড়ল হয়ে থাকে। এই মেয়েটিকে তারা উপেক্ষা করছে। মেয়েটি তাদের কথা মন দিয়ে শুনছে। যখন তার হাসা উচিত, হাসছে। যখন গম্ভীর হওয়া উচিত, হচ্ছে। নিশ্চিত যে সেই লোকগুলোকে চেনে না। তার হাসি তার মনের ভেতরের লজ্জাকে ঢাকার একটা উপায় মাত্র। ভিনসেন্ট উঠল, মেয়েটির টেবিলের দিকে গেল। তাদের দলে যোগ দিয়ে মেয়েটির সঙ্গে গল্প করতে লাগল। তারপর তারা দুজনে আলাদা হয়ে গেল। শুরু হলো রাজ্যের যত গল্প। মেয়েটির নাম জুলি। সে ছোট্ট একটা চাকরি করে। পতঙ্গবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যানের টাইপিস্ট। বিকেলে তার কোনো কাজ থাকে না। তাই সে এই বিখ্যাত ভবনে এসেছে। পতঙ্গবিদদের দেখবে বলে। গতকাল পর্যন্ত সে কোনো পতঙ্গবিদ দেখেনি। তারা তার কৌতূহলকে উসকে দিচ্ছে। যদিও সে তাদের আড়ালে পড়ে আছে এক ভীত হরিণীর মতো। ভিনসেন্ট মেয়েটির সঙ্গ উপভোগ করছে। তাকে গলা উঁচিয়ে কথা বলতে হচ্ছে না। বরং সে নিচু গলায় কথা বলছে, যাতে অন্যরা তা শুনতে না পায়। তারপর সে তাকে আরেকটা টেবিলে নিয়ে যায়। যাতে তারা পাশাপাশি বসতে পারে। সে তার হাত রাখে তার হাতে। 

সে বলে, ‘তুমি জানো, সবকিছু নির্ভর করছে কণ্ঠস্বরের শক্তির ওপরে। সুন্দর মুখের চেয়েও তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
‘তোমার গলা ভারি সুন্দর।’
‘তোমার তা মনে হয়?’
‘হ্যাঁ। তাই মনে হয়।’
‘কিন্তু দুর্বল!’
‘এটাই তোমার গলার সৌন্দর্য। আমার গলা বাজে, কাকের মতো কর্কশ! তোমার কি তা মনে হয় না?’
ভিনসেন্ট আদুরে গলায় বলে, ‘না। আমি তোমার গলার স্বর পছন্দ করি। এটা বেশ উসকানিমূলক। বেশ ভারিক্কিও।’
‘তোমার তাই মনে হয়?’
‘তোমার গলার স্বর তোমারই মতো।’ আদরমাখা গলায় ভিনসেন্ট বলে, ‘তুমি নিজে বেশ একজন মানুষ, যে অন্যকে জাগিয়ে তোলে। অন্যের শ্রদ্ধাও আকর্ষণ করে।’
জুলির এ কথা পছন্দ হয়। সে বলে, ‘আমিও সে রকমই ভাবি।’
ভিনসেন্ট বলে, ‘এই লোকগুলো গাড়ল।’
‘হ্যাঁ। ঠিক বলেছ!’
‘লোকদেখানো ভাব। বুর্জোয়া। বার্ককে দেখেছ? একটা গাধা।’
জুলিও তার কথায় সায় দেয়। লোকগুলো এতক্ষণ তাকে একদম পাত্তা দেয়নি। যেন তাকে তারা দেখেইনি। কাজেই এই লোকগুলোর বিরুদ্ধে যা কিছু বলা হবে, সে তাতেই সমর্থন দেবে। প্রতিশোধ নেওয়া হচ্ছে। ভিনসেন্টকে তার খুব ভালো লেগে যাচ্ছে। দেখতে ভালো। হাসিখুশি। কোনো দেখানেপনা নেই।
ভিনসেন্ট বলে, ‘আমার মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটা লন্ডভন্ড করে দিই।’
খুব সুন্দর কথা। বিদ্রোহের প্রতিশ্রুতির মতো শোনাচ্ছে। জুলি হাসে। তার মনে হচ্ছে সে হাততালি দেয়।
ভিনসেন্ট বলে, ‘আমি তোমার জন্য হুইস্কি আনছি।’ সে উঠে বারের দিকে যায়।
(চলবে)