ধীরে চলা

১৮ 

টেবিলের একপ্রান্তে বক্তারা বসেছেন। একজনের পর আরেকজন বলছেন। চেক বিজ্ঞানী অন্যদের কথা শুনছেন না। তিনি নিজের পালা আসার জন্য অপেক্ষা করছেন। মাঝেমধ্যে পকেটে হাত দিয়ে দেখছেন, তার পাঁচ পৃষ্ঠা বক্তৃতা ঠিকঠাক আছে কি না। বক্তৃতাটা খুব ভালো কিছু না, তিনি নিজেও জানেন। ২০ বছর ধরে তিনি বিজ্ঞানচর্চার বাইরে। কুড়ি বছর আগে একজন নবীন গবেষক হিসেবে তিনি মাছির একটা প্রজাতি আবিষ্কার করেছিলেন, Musca Pragensis. সেই সময় তাঁর যে পেপার বেরিয়েছিল, সেসবেরই একটা সারমর্ম তৈরি করে এনেছেন। সভার সভাপতি কতগুলো শব্দ উচ্চারণ করলেন, সেসব তাঁর নামের অংশে আছে—এটা তাঁরই নাম নিশ্চয়ই, তিনি আসন থেকে উঠে বক্তাদের সারিতে চলে গেলেন।

কুড়িটা সেকেন্ড লাগল তাঁর উঠে হেঁটে যাওয়াতে। এই কুড়ি সেকেন্ডেই তিনি খুব আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলেন। ও খোদা, বিশটা বছর পরে তিনি ফিরে এসেছেন তাঁর শ্রদ্ধাভাজন লোকদের মধ্যে, যাঁরা তাঁকে শ্রদ্ধা করেন। এসব বিজ্ঞানী, যাঁরা তাঁকে আত্মীয় বলে মনে করেন, তিনিও যাঁদের আত্মীয় জ্ঞান করেন। ভাগ্য তাঁকে এতটা বছর এঁদের মধ্যে থেকে ছিনিয়ে অন্যত্র নিয়ে গিয়েছিল। যখন তিনি টেবিলের প্রান্তে তাঁর জন্য অপেক্ষমাণ খালি চেয়ারটার কাছে গিয়ে পৌঁছালেন, তিনি বসলেন না। তিনি তাঁর আবেগের আদেশ পালন করলেন, তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর সতীর্থদের কাছে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে লাগলেন।
‘ক্ষমা করবেন, প্রিয় ভদ্রমহিলা ও প্রিয় মহোদয়গণ। আমি আমার আবেগ ধরে রাখতে পারছি না। ভাবিওনি যে আমি এতটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ব। আমি একটু বিস্মিতই বোধ করছি। বিশটা বছর অনুপস্থিত থেকে আমি আবার কথা বলতে পারছি সেই মানুষদের সামনে, যাঁরা আমার মতো একই রকমের সমস্যা নিয়ে ভাবেন, যাঁরা আমার মতো একই ভালো লাগা দিয়ে উত্তেজিত হন। আমি এমন একটা দেশ থেকে এসেছি, যেখানে একজন মানুষ শুধু তার নিজের মনের কথা প্রকাশ্যে বলেছে বলে তার জীবনের মানে থেকে বঞ্চিত ছিল। একজন বিজ্ঞানীর জন্য জীবনের মানে কী! বিজ্ঞান। আপনারা জানেন, হাজার হাজার মানুষকে, আমার দেশের সব বুদ্ধিজীবীকে ১৯৬৮ সালের সেই বিয়োগান্ত গ্রীষ্মের পর তাঁদের স্ব স্ব পদ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। মাত্র ৬ মাস আগে আমি ছিলাম একজন নির্মাণশ্রমিক। না, তাতে কোনো অসম্মান নেই। সাধারণ মানুষদের সঙ্গে মিশে সাধারণ কাজ করা, তাদের কথা জানা, এসবই সম্মানের। কিন্তু এর ফলে একটা উপলব্ধিও হয়। আমরা যারা বিজ্ঞানকে ভালোবাসি, বিজ্ঞান নিয়ে সাধনা করি, আমরা আমাদের ভালোবাসার কাজটা করতে পারি, এটা একটা সুযোগ। এমন একটা সুযোগ, বন্ধুগণ, আমার সহকর্মী নির্মাণশ্রমিকেরা যার কথা কোনো দিনও জানতে পারবে না। এটা তো অসম্ভব, হাতুড়ি কিংবা শাবলের প্রতি আপনি কীভাবে ভালোবাসা দেখাবেন? এই সুযোগ থেকে কুড়িটা বছর আমাকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। আমি আবার ফিরে এসেছি। আমি এটা নিয়ে ঘোরলাগা অবস্থায় আছি। তাই, প্রিয় বন্ধুগণ, এই মুহূর্তটিকে আমি উদ্‌যাপন করতে চাই। যদিও আমি বিষণ্নও বোধ করছি।’
যখন তিনি তাঁর শেষ বাক্যটি বলছেন, তাঁর চোখ ভিজে উঠল। কথা শেষ হওয়ার আগেই বার্ক দাঁড়িয়ে পড়লেন, হাততালি দিতে লাগলেন। ক্যামেরা ছিল সেখানে। বার্কের মুখের ছবি ধারণ করা হলো। চেক বিজ্ঞানীর মুখও ধরা পড়ল ক্যামেরায়। পুরো রুম দাঁড়িয়ে পড়ল, কেউ দাঁড়ালেন আস্তে আস্তে, কেউ দাঁড়ালেন দ্রুত, কারও মুখে হাসি, কারও মুখ গম্ভীর, তাঁরা এতটাই উপভোগ করছেন যে জানেন না কখন থামতে হবে। চেক বিজ্ঞানী তাঁদের সামনে দাঁড়ানো, অস্বাভাবিক লম্বা, খুবই বেঢপ লম্বা, তাঁর মুখ থেকে সেই বেঢপ ব্যাপারটা বিকিরিত হচ্ছে, যতই হচ্ছে ততই তিনি আবেগাপ্লুত বোধ করছেন। তাঁর চোখের জল আর চোখের পাতার আড়ালে থাকতে পারছে না, তাঁর নাকের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। তাঁর মুখ বেয়ে, তাঁর চিবুক বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, তাঁর সহকর্মীদের সামনে, যাঁরা আরও জোরে আরও জোরে হাততালি দিচ্ছেন।
অবশেষে তাঁর এই অভিনন্দন পর্ব শেষ হয়ে এল। ‘ধন্যবাদ, বন্ধুগণ, ধন্যবাদ, আমার হৃদয়ের গভীর থেকে ধন্যবাদ।’ বলে তিনি তাঁর চেয়ারের দিকে হাঁটতে লাগলেন। এটা তাঁর জীবনের সবচেয়ে গৌরবের মুহূর্ত। একটা কথা না বলেও তিনি নিজেকে সুন্দর এবং মহান ভাবতে পারছেন। তিনি এখন বিখ্যাত। আহা, তাঁর চেয়ার পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার এই সময়টা যদি কোনো দিনও শেষ না হতো!
[অনুবাদকের টিপ্পনী:
হ্যাঁ। আমরা বার্ককে পেয়েছি। বার্ক হাততালি দিচ্ছেন। তিনি ভালোবাসেন ক্যামেরা। সঠিক সময়ে তিনি ক্যামেরাও পেয়ে গেলেন। আমরা এরপর ১৯তম অধ্যায়ে যাব। প্রিয় পাঠক, যদিও আমরা ভেরা আর তার স্বামীকে ভুলে গেছি, ভুলে গেছি যে লোকটা হোটেলের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে, তবুও পরের পর্বগুলোয় আপনাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখি]
(চলবে)

আরও পড়ুন: