গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

মনীষাভ্রমণ

আন্তন চেখভের সান্নিধ্যে

বোকার মতো কাজ করো। সফল জীবনের পেছনে ছুটে নিজের শক্তি, মানসিকতা ক্ষয় করার চেয়ে বোকামিই আসলে অর্থবহ আর স্বাস্থ্যকর।
আন্তন চেখভ

আমি শহর থেকে শহরে ছুটছি। কেন ছুটছি জানি, কিন্তু কবে ছোটা শেষ হবে জানি না। অস্থির হয়ে পড়ছি ছুটতে ছুটতে। কাউকে না দেখতে পাওয়ার অস্থিরতা। কেউ দেখা দিচ্ছে না, এই ভাবনাও মনের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।

এখন আছি রাশিয়ার তুলা শহরে। এ শহরের একটা হাসপাতালে এসেছিলেন ডা. আন্তন চেখভ। পরোপকারী ডাক্তার হিসেবে বেশ নামডাক ছিল। তিনি সব সময় বলতেন, রোগীর সেবা হলো তাঁর স্ত্রী আর সাহিত্যচর্চা হলো প্রেমিকা। সাহিত্যে অমর, সেবাপাগল ব্যক্তিকে খোঁজার জন্য কেনই বা ছুটব না! যদিও তুলা শহরে আমি এসেছিলাম কাছের ইয়াসনায়া পলিয়ানায় লিও তলস্তয়ের জন্মস্থান দেখতে; কিন্তু আন্তন চেখভ কি তলস্তয়ের কম প্রিয় ছিলেন! তলস্তয়ের শেষ দিনগুলোতে তিনি চেখভের লেখাই পড়তেন বা পড়তে চাইতেন। চেখভও এখানে এসেছিলেন তলস্তয়ের সঙ্গে দেখা করতে।

তুলা শহরের হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে জানলাম আগের হাসপাতালটির অবয়ব আর নেই। ভেঙে নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। হাসপাতালের ভেতরে ঢুঁ মেরে এসেছি। আউটডোরে এখন কেউ নেই। আর ওপরের তলায় যাওয়ার ইচ্ছা জাগেনি। কারণ, এখানে তো চেখভ হেঁটে বেড়াননি। তিনি এসেছিলেন পুরোনো ভবনে, নিচতলায় ছিলেন কিছুক্ষণ। হাসপাতালের আগের পুরোনো ভবনের ওপর নতুন ভবনটি বেশ ঝাঁ চকচকে। আমার জন্যই বোধ হয় চেখভ বলেছিলেন, ‘বোকার মতো কাজ করো। সফল জীবনের পেছনে ছুটে নিজের শক্তি, মানসিকতা ক্ষয় করার চেয়ে বোকামিই আসলে অর্থবহ আর স্বাস্থ্যকর।’

আমি ট্রেনে করে দুই শ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আবার ফিরে আসি মস্কো শহরে। এখানে একটি ছোট অ্যাপার্টমেন্টে কেটেছিল আন্তন চেখভের বেশ কয়েক বছর। পরিবার–অন্তঃপ্রাণ এই ডাক্তার সাহেব কিন্তু স্ত্রীর প্রতি ছিলেন উদাসীন। নিজের লেখা নাটক মঞ্চস্থ করার সময়ে স্ত্রী ওলগার সঙ্গে পরিচয় হলেও বিয়ের পরও তাঁরা আলাদা আলাদা শহরে বসবাস করতেন। তিনি বলেছিলেন, ‘একাকিত্বকে ভয় পেলে কখনো বিয়ে কোরো না।’ একজন মহান লেখকের চিন্তার জগৎ এবং চিন্তার সৌন্দর্য এখানেই।

এখন আছি রাশিয়ার তুলা শহরে। এ শহরের একটা হাসপাতালে এসেছিলেন ডা. আন্তন চেখভ। পরোপকারী ডাক্তার হিসেবে বেশ নামডাক ছিল। তিনি সব সময় বলতেন, রোগীর সেবা হলো তাঁর স্ত্রী আর সাহিত্যচর্চা হলো প্রেমিকা।

তুলা শহর থেকে ফিরে এসে আমি গেলাম রুশ সাহিত্যের ছোটগল্পের জ্বলজ্বলে প্রদীপ আন্তন চেখভের মস্কোর বাড়িতে। দেশবাসী তাঁকে শেখভ নামেও ডাকে। মস্কোর এই বাড়ির একটি ছোট অ্যাপার্টমেন্টে বাস করতেন লেখক।

৬ নম্বর সাদোভায়া কুদরিন্সকায়া স্ট্রিটের লাল রঙের দোতলা বাড়িটির সামনে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম। নিশ্চয়ই চেখভ এ পথ ধরেই বাড়ি ফিরতেন। যেমন আমি অপেক্ষায় আছি তাঁর বাড়ি ফেরার। কেমন হয়, যদি তিনি হুট করে চলে আসেন!

আশপাশের সব বাড়ি ভেঙে নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। শুধু সাদা বর্ডার দেওয়া লাল বাড়িটিই রয়ে গিয়েছে। বাড়িটি এখন মস্কো স্টেট লিটারেরি মিউজিয়াম নামের সংস্থার অন্তর্গত। চেখভ এ বাড়িতে ১৮৮৬ থেকে ১৮৯০ সাল অবধি বসবাস করেছিলেন। এ সময়ে তিনি এই বাড়ির একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে থাকতেন।

চেখভ এ বাড়িতে ১৮৮৬ থেকে ১৮৯০ সাল অবধি বসবাস করেছিলেন

সড়ক ছেড়ে আমি মূল বাড়িতে প্রবেশ করলাম। রাশিয়ার অন্য লেখকদের বাড়ির চেয়ে এ বাড়িটি তুলনামূলকভাবে বেশ সুনসান। দু–একজন ছাড়া দর্শনার্থী নেই। বা এমনও হতে পারে যে তাঁরা পরে আসবেন। আমি তো সকালেই এসে পড়েছি।

দোতলার সামনের দিকের দুটি কক্ষ ভাড়া করে বসবাস করতেন লেখক আন্তন চেখভ ও তাঁর ভাই। প্রবেশপথের পরেই একটা প্যাসেজ। প্যাসেজ পার হয়ে সামনে চেখভের বসার ঘর। বসার ঘরে পাশাপাশি এক সেট সোফা রাখা। সোফাগুলো সাদা রঙের কভার দিয়ে ঢাকা। সোফা সেটের সামনে একটা ছোট সেন্টার টেবিল, তার ওপর টেবিল ক্লথ বিছানো আর তার ওপরে একটা ছোট ল্যাম্প রাখা।

একই কক্ষের আরেক পাশে লেখকের লেখার টেবিল দেখলাম। টেবিলটি খুবই সাধারণ আর আকারে ছোট। টেবিলের ওপর চেখভের বাঁধাই করা কয়েকটি ছবি, তাঁর ব্যবহৃত টেবিল ঘড়ি, কলমদানি, টেবিল ল্যাম্প রাখা। সোফা সেটের পেছনে একটি বইয়ের শোকেসে কিছু বই রাখা।

জীবদ্দশায় চেখভ বিভিন্ন শহরের বিভিন্ন বাড়িতে বসবাস করেছেন। এই অ্যাপার্টমেন্টেও তিনি অল্প কয়েক বছর বসবাস করেছিলেন। এর মধ্যেই তিনি ইউক্রেন চলে গিয়েছিলেন, আবার ফিরেও এসেছিলেন। ‘এ বাড়িতে তাঁর বেশি জিনিসপত্র নেই’—বললেন আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন গাইড। তিনি কয়েকজন রাশিয়ান দর্শনার্থী নিয়ে এসেছেন। আরও বললেন, বেশির ভাগ আসবাবপত্র নাকি চেখভের সময়ের; কিন্তু এ বাড়ির নয়। আমি মনেপ্রাণে চাই তাঁর এ কথা ভুল হোক। আমি সামনে যা দেখছি তা যেন চেখভেরই হয়। সামনেই একটা শোকেসে রোগীদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত নানা আকারের ওষুধের বোতল রাখা। শোকেসের মাঝখানে রাখা চেখভের চশমা, যে চশমার কোনো ফ্রেম নেই, শুধু গোলাকার কাচ আর নাকের ওপর ধরে রাখার জন্য একটা হুক, এক পাশ থেকে ঝুলে আছে একটা চেইন। এই চশমা দেখে বোঝাই যাচ্ছে এটা ঊনবিংশ শতকের চশমা এবং অবশ্যই চেখভের ব্যবহৃত চশমা।

টেবিলের ওপর তাঁর ব্যবহৃত টেবিল ঘড়ি, কলমদানি, টেবিল ল্যাম্প রাখা। সোফা সেটের পেছনে একটি বইয়ের শোকেসে কিছু বই রাখা। এ বাড়িটি ছাড়াও রাশিয়ায় চেখভ এ রকম আরও অর্ধ ডজন বাড়িতে বসবাস করেছিলেন।

এই কক্ষের ওয়াল পেপারের রং হালকা অলিভ, তাতে নকশা কাটা। দেয়ালে ফ্রেমে ঝুলছে চেখভের নানা বয়সের ছবি। পাশের কক্ষটি চেখভের শোবার ঘর। সে কক্ষে সাদা চাদরে ঢাকা একটি সিঙ্গেল বিছানা আছে আর পাশে সাদা কাপড়ে ঢাকা একটি বেডসাইড টেবিল। চেখভের শোবার কক্ষটিতে প্রবেশ নিষেধ, তাই দূর থেকেই দেখে নিতে হলো। বসার ঘর পার হলে আরও একটা কক্ষ যেখানে কোনো আসবাবপত্র নেই, ঘরের মাঝখানে একটা লম্বা কাচের দেয়াল, দেয়ালে কাঠের ফ্রেম আর সেখানে ঝুলছে চেখভের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির পাতা, চিঠি, ছাপা হওয়া বইয়ের পাতা ইত্যাদি। এ ছাড়া এই অ্যাপার্টমেন্টে চেখভের স্মৃতিকে জড়িয়ে রাখার মতো আর কিছুই নেই। পরের কক্ষটি বলতে গেলে শূন্য। কক্ষের মাঝখানে একটা সেন্টার টেবিলে চেখভের বই পাতা খুলে রাখা আছে।

এ বাড়িটি ছাড়াও রাশিয়ায় চেখভ এ রকম আরও অর্ধ ডজন বাড়িতে বসবাস করেছিলেন। সাধারণ জীবন যাপন করতেন, তাই এ বাড়িতে খুব বেশি আসবাব নেই।

চেখভের বসার ঘর

আন্তন পাভলোভিচ চেখভ ১৮৬০ সালে রাশিয়ার তাগানরগ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। তবে তাঁর বাবা ছিলেন বেজায় বদমেজাজি ও দায়িত্বজ্ঞানহীন। চেকভের বয়স যখন ১৬ তখন বাবা দেউলিয়া হয়ে শহর ছেড়ে পালিয়ে যান। বাবার ঋণ ও সংসারের দায়িত্ব পালন করার জন্য তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি পত্রিকায় লিখে, ছবি এঁকে উপার্জন করতেন। এরপর নিজ শহর ছেড়ে মস্কোতে এসে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৮৮৪ সালে ডাক্তারি পাস করার পর তিনি মস্কোতে রোগী দেখা শুরু করেন। দরিদ্র রোগীদের তিনি বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন। এমনকি ওষুধের জোগানও দিতেন।

এ সময় তিনি মস্কোর এ বাড়িটিতে ভাইয়ের সঙ্গে বসবাস করেন এবং এই বাড়িতে বাস করা অবস্থায়ই তিনি লেখক হিসেবে সমাজে স্বীকৃতি পান এবং ‘পুশকিন পুরস্কার’ পান। মস্কোর এই বাড়িতে তিনি উল্লেখযোগ্য রচনা ‘দ্য স্টেপ’, ‘লেডি অ্যান্ড দ্য ডগ’, ‘দ্য কিস’ ইত্যাদি গল্প ও উপন্যাস লেখেন।

এরপর তিনি কালজয়ী রচনা ‘সিগাল’, ‘থ্রি সিস্টার্স’, ‘দ্য চেরি অরচার্ড’ লেখেন। এই রচনাগুলো তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়।

এরপর মস্কো থেকে ১৮৯০ সালে তিনি সাখালিন দ্বীপে বন্দীদের ডাক্তার হিসেবে সেবা দেন। সেখানকার অভিজ্ঞতা তাঁর রচনায় এক নতুন মোড় দেয়। সাখালিন থেকে ফিরে এসে মস্কোর কাছেই মালিকোভো নামের জায়গার জমিদারি কিনে নেন। নিজ উদ্যোগে সেখানে হাসপাতাল, স্কুল ইত্যাদি নির্মাণ করেন। নিজের জমিদারির মতোই চালান মালিকোভোকে। এখানে আলাদা পোস্ট অফিসও চালু হয়।

চেকভের বয়স যখন ১৬ তখন বাবা দেউলিয়া হয়ে শহর ছেড়ে পালিয়ে যান। বাবার ঋণ ও সংসারের দায়িত্ব পালন করার জন্য তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি পত্রিকায় লিখে, ছবি এঁকে উপার্জন করতেন।

মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করার পর চেখভ যখন মস্কোর বাড়িতে বসবাস করছিলেন তখনই যক্ষ্মা ধরা পড়ে। তবে নিজে চিকিৎসক হওয়ার কারণে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারেনি। ১৮৯৭ সালে যক্ষ্মা বেড়ে যায়। এরপর তিনি কিছুদিন প্যারিসে কাটিয়ে আবার রাশিয়ার ইয়ালতা শহরে ফিরে আসেন। স্বাস্থ্যরক্ষা করে যতখানি সম্ভব রোগীর সেবায় মন দেন চেখভ।

চেখভের শৈশব, কৈশোর ছিল ট্রমায় পরিপূর্ণ। অত্যাচারী পিতার কারণে স্বাভাবিক জীবন থেকে বঞ্চিত ছিলেন আর অল্প বয়সেই সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিল। আন্তন চেখভের একটা কথা আমার মনে দাগ কেটেছিল, ‘ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধা মানুষকে একত্রে মিলিত করতে পারে না, যতটা পারে ঘৃণা।’

আন্তন চেখভের বিবাহভীতি ছিল ষোলো আনা। ১৯০১ সালে মস্কো থিয়েটারের শিল্পী ওলগার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন চেখভ। কিন্তু এর মধ্যেই শরীর বিদ্রোহ করে বসে। ওলগা সবকিছু জেনেই চেখভকে গ্রহণ করেছিলেন। চেখভ অবশ্য ওলগার সঙ্গে মস্কোয় বসবাস করেননি বা ওলগাকেও দুই হাজার কিলোমিটার দূরে ইয়ালতায় তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাননি। তাঁরা আলাদা শহরে বসবাস করতেন।

১৯০৪ সালে ‘চেরি অরচার্ড’ থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় এবং নাটকটি বেশ সাড়া ফেলে। তত দিনে আন্তন চেখভের শরীর ভেঙে পড়েছে। হাওয়া বদলের জন্য ওলগাকে নিয়ে চলে যান জার্মানিতে এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। জার্মানি থেকে চেখভকে নিজ ভূমি রাশিয়ায় ফিরিয়ে এনে মস্কোর নভোদেভিচি সেমিট্রিতে বাবার পাশে সমাহিত করা হয়।

মস্কোর নভোদেভিচি সেমিট্রিতে আন্তন চেখভের সমাধি ফলক

মস্কোর আরেক প্রান্তে তিনি যখন আছেনই তাহলে সেখানে না গেলেই নয়। পরদিন তাই আমি নভোদেভিচি সেমিট্রিতে চলে এলাম। নভোদেভিচি সেমিট্রি বা নভোদেভিচি কনভেন্ট আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ষোড়শ শতকে নির্মিত এই কনভেন্ট দেখতে একদম স্বপ্নের রাজপুরীর মতো। যত দূর চোখ যায় সবুজ ঘাসের লন, নানা রঙের ফুলের বাগান, প্রাসাদ আকারের গির্জা, এদিক–সেদিকে সাজানো কটেজ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। আর এই স্বপ্নরাজ্যের সবচেয়ে সুন্দর বাগানটি গোলাপ ফুলে ভরে গেছে। দূর থেকে মিষ্টি সুবাস আসছে। আর এই সাজানো উদ্যানের মধ্যে রাজসিংহাসনের মতো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছে কয়েক শ বছরের বেশ কিছু সমাধি। সমাধিফলকের ঐশ্বর্য যেকোনো কারুকাজকে হার মানায়। আমি এই সমাধির মধ্যেই আন্তন চেখভের সমাধি খুঁজতে শুরু করলাম। কিন্তু কোথাও তাঁর নাম খুঁজে পেলাম না। একে তো রাশিয়ান ভাষা জানি না, তার ওপর এই বিশাল কনভেন্টে কেউ নেই যে জিজ্ঞেস করব। আমি এখানে সত্যি সত্যিই এলিস হয়ে গিয়েছি। বিশাল এক ওয়ান্ডারল্যান্ডে এসে খেই হারিয়ে ফেলেছি। এখানে আমি চেখভকে কোন মন্ত্রবলে যে খুঁজে পাব!

কালো রঙের নকশা করা গ্রিল দিয়ে ঘেরা চেখভের সমাধি। সমাধির পাশে লাল টকটকে একগুচ্ছ গোলাপ একটা ফুলদানিতে রাখা। দেখে মনে হচ্ছে, চেখভের ঘরের সামনে কেউ ভালোবেসে গোলাপের রং ছড়িয়ে গেছে।

পুরো কনভেন্ট ঘোরা হয়ে গেলে একদম শেষ মাথায় এখানকার একজন কর্মীর সঙ্গে দেখা হলো। না তিনি জানেন ইংরেজি, না আমি জানি রুশ ভাষা। তবে ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন যে চেখভ এখানে নেই। আরও বললেন, চেখভকে দেখতে হলে এই কনভেন্ট থেকে বের হয়ে পাশের সেমিট্রিতে যেতে হবে। আমিও এই পরোপকারী ভালো মানুষের কথামতো কনভেন্ট থেকে বের হয়ে হাঁটতে থাকলাম সেমিট্রির দিকে। পথ নেহাত কম নয়। অনেকটা পথ হেঁটে সেমিট্রির মূল ফটকের দেখা মিলল।

নভোদেভিচি সেমিট্রিতে এসেছি সেই কখন! দুপুর হতে চলল; কিন্তু যাঁর সমাধি খুঁজছি তা পাচ্ছি না। ২৬ হাজার সমাধির মধ্যে একজনকে খুঁজে পাওয়া যে কত মুশকিল, তা আগে বুঝতে পারিনি। সেমিট্রির রিসেপশনে আমাকে একটা ম্যাপ ধরিয়ে দিতে চাইল, কিন্তু তা রাশিয়ান ভাষায় লেখা। রাশিয়ান ভাষার ম্যাপ আমার কোনো কাজে আসবে না। তাই ম্যাপ সঙ্গে না নিয়েই চলে এসেছি। এদিকে আকাশ থমথমে হয়ে আছে। আমি দিশাহারা পথিক। এক এক করে খুঁজতে গিয়ে দেখি মাত্র দুই শর মতো সমাধি দেখেছি সকাল থেকে দুপুর অবধি। এভাবে হবে না বুঝতে পারছি আর মনে হচ্ছে বুঝেশুনেই বোকামি করছি। অবশ্য একটিমাত্র সমাধি খুঁজতে গিয়ে বোকা বনে যাওয়াই যায়। কিন্তু বাদ সাধছে প্রকৃতি। ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল আর ঝরতেই থাকল।

চেখভের সমাধি ফলকের সামনে লেখক

এই সেমিট্রিতে সারি সারি সুসজ্জিত সমাধি আছে, সমাধির ওপরে সমাধিফলক খুব যত্ন করে করা হয়েছে; কিন্তু বৃষ্টিতে ঠাঁই নেওয়ার জায়গা আশপাশে খুঁজে পেলাম না। অগত্যা ছাতা মাথায় হাঁটতে হাঁটতে এই জনমানবহীন সেমিট্রিতে একজন বিশেষ মানুষকে খুঁজতে থাকি। ছাব্বিশ হাজার সমাধি, চুয়াল্লিশ বছর বয়স্ক এক ব্যক্তি আর আমি যেন সবাই সবার চেয়ে একা। চেখভের চেয়ে একা, বিষণ্ন ব্যক্তি আর কেউ ছিলেন না। শৈশব, কৈশোরের বিষণ্নতার বোঝা বহন করে বেড়িয়েছেন সারা জীবন।

কিছুক্ষণ সমাধির সারির পাশ দিয়ে হাঁটার পর একজন মানুষের দেখা পেলাম। তিনি কি দেবদূত হয়ে আমার জন্য এসেছেন? আমি যাঁকে খুঁজছি তাঁর নাম বলতেই হাতের ইশারায় ডেকে দূরের এক গহিন জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গেলেন। সেখানে সারি সারি সমাধিকে পাহারা দিচ্ছে উঁচু উঁচু গাছপালা। আর এর নিচে মানুষেরা শান্তিতে ঘুমাচ্ছেন শত শত বছর ধরে।

দেবদূত ভদ্রলোকটি আসলে এই সেমিট্রির মালি। যাঁকে খুঁজছি তাঁর সমাধির কাছে নিয়ে আমায় তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি অবাক চোখে চেয়ে থাকি দোচালা ঘরের মতো লম্বা সরু সমাধির দিকে। এখানেই কি তিনি ঘুমাচ্ছেন, যিনি নিজেকে প্রথমে পরিবার ও পরে জনগণের সেবায় উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন! যাঁর লেখায় বিভিন্নভাবে উঠে এসেছে সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন ঘটনার কথা, মানুষের চরিত্রের বিভিন্ন দিকের কথা। এই সেই লেখক, যিনি অল্প বয়সে পিতার ঋণের দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, সেই পিতার পাশেই তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে। মনস্তত্ত্ববিদেরা একটা শব্দ ব্যবহার করেন—ট্রমা বন্ড। মানে যে অনেক আঘাত দেয় তার প্রতিই অনুরক্ত থাকা। চেখভ কি ট্রমা বন্ড ছিলেন! এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। তবে এই কদিন চেখভকে খুঁজতে খুঁজতে শুধু এ কথাই মনে হয়েছে যে তাঁর মতো কোমল হৃদয়ের ব্যক্তি আর দ্বিতীয়টি ছিল না। আর এই ব্যক্তিই সবচেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন।

কালো রঙের নকশা করা গ্রিল দিয়ে ঘেরা চেখভের সমাধি। সমাধির পাশে লাল টকটকে একগুচ্ছ গোলাপ একটা ফুলদানিতে রাখা। দেখে মনে হচ্ছে, চেখভের ঘরের সামনে কেউ ভালোবেসে গোলাপের রং ছড়িয়ে গেছে। যেন একেকটা গোলাপ চেখভের রচনার একেকটি চরিত্র হয়ে সুবাস ছড়াচ্ছে। আর সেই সুবাসের টানে এই ঘোর বাদল দিনে ছুটে এসেছেন সুন্দর সুন্দর কয়েকজন ভক্ত। যাঁরা চেখভকে ভালোবাসেন তাঁরা তো সুন্দরই। চেখভ যেন ভক্তদেরই বলেছেন, ‘মানুষকে সুন্দর সব দিক থেকে হতে হয়; চেহারায়, পোশাক–পরিচ্ছদে, চিন্তায় এবং অন্তরাত্মায়।’