
কেমব্রিজ ইসলামিক কলেজের ডিন ড. মুহাম্মদ আকরাম নদভি ৪৩ খণ্ডের একটি চরিতাভিধান রচনা করেছেন ইসলামের ইতিহাসে নারী হাদিস বর্ণনাকারীদের নিয়ে; যাদের বলা হয় ‘আল–মুহাদ্দিসাত’। ২০২১ সালে প্রকাশিত গ্রন্থটিতে প্রায় ১০ হাজার স্কলার নারীর জীবন–কর্ম স্থান পায়। লন্ডন মুসলিম সেন্টারের চ্যানেলে এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন তিনি। অনুবাদ করেছেন মারদিয়া মমতাজ ও শরিফ সাইদুর।
যদি পৃথিবীর অন্য ধর্মের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে আর কোনো ধর্মে নারীরা ধর্মীয় গবেষণায় এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেননি। হিন্দু, খ্রিষ্টান কিংবা ইহুদিদের কয়েক শ বছরের ধর্মীয় ইতিহাসেও এমন তথ্য পাওয়া যাবে না। অথচ ইসলামের অন্তত এক–চতুর্থাংশ জ্ঞান দাঁড়িয়ে আছে কেবল নারীদের বর্ণনার ওপর, বাকি তিন–চতুর্থাংশ আছে নারী ও পুরুষদের যৌথ বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে।
ইসলামি জ্ঞানের প্রতিটি ধারা, যেমন ইবাদত, কেনাবেচাসংক্রান্ত বিধান ইত্যাদির ওপর নারী সাহাবিদের বর্ণনা আছে। এমনকি মাজহাবভেদেও বহু অবদান পাওয়া যায়। হানাফি, মালেকি ইত্যাদি মাজহাবের অনেক বিধিবিধানের ব্যাখ্যা কোনো নারীর বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়েছে এবং মানুষ সেগুলোকে সশ্রদ্ধভাবে মেনেও নিয়েছে।
একটি উদাহরণ দিই। পবিত্র কোরআনের পরে ইসলামি শরিয়তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো সহিহ বুখারি। এর আবার বিভিন্ন সংস্করণ আছে, বিভিন্ন স্থানে সেগুলো সংরক্ষিত আছে।
মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সহিহ বুখারির কপিটি যাঁর কাছে সংরক্ষিত ছিল, তিনি একজন নারী, কারিমা আল–মারজিয়্যাহ। তিনি মক্কায় বাস করতেন। ৪৬৪ হিজরিতে মৃত্যুবরণ করেন।
আপনি যদি প্রশ্ন করেন, কোন সংস্করণটি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য? মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কপিটি যাঁর কাছে সংরক্ষিত ছিল, তিনি একজন নারী। তাঁর নাম কারিমা আল–মারজিয়্যাহ, যিনি ৪৬৪ হিজরিতে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি মক্কায় বাস করতেন। বাগদাদ ও মধ্য এশিয়া থেকে মানুষ তাঁর কাছে যেতেন এবং এই বিশুদ্ধতম কপিটি থেকে হাদিস সংগ্রহ করতেন।
কেন এটিকে এত নির্ভুল ধরা হতো? কারণ, তিনি কাউকে এর বেচাবিক্রির অনুমতি দিতেন না; বরং কেউ যদি হাদিস সংগ্রহ করতে চাইতেন, তাঁকে নিজ হাতে ওই কপি থেকে হাদিস লিখে নিতে হতো। এরপর তিনি আবার তা যাচাই করে দিতেন। হাদিস সংগ্রহের ইতিহাসে আমরা এত সাবধানী ও সতর্ক আর কাউকে পাইনি।
এখন আমরা বুখারির যে সংস্করণটি পাই, তা তুরস্কের সুলতান আবদুল হামিদের সংকলন করা ‘নুসখা সুলতানিয়া’। এই সংস্করণ ছিল কারিমা আল–মারজিয়্যার কপিটি থেকে সংগৃহীত ‘নুসখা ইউনিনিয়্যাহ’–এর সরাসরি কপি। এ কাজটি করেছিলেন মদিনার বিখ্যাত শিক্ষক শেখ জুহায়ের নাসির। আমরা ‘ফাতহুল বারী’তে যে সংস্করণ পাই, তা অবিকল কারিমা আল মারজিয়্যার সংরক্ষিত গ্রন্থের কপি।
চিন্তা করে দেখুন, কতটা বিশুদ্ধতার সঙ্গে এটিকে সংরক্ষণ করেছিলেন একজন নারী। আমাদের উচিত তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ হওয়া। অথচ আমি যখন মুহাদ্দিসাতদের নিয়ে ইংলিশ বইটি প্রকাশ করি, এ অঞ্চলের বহু আলেম আমাকে বলেছেন, ‘কী দরকার নারীদের কাজ নিয়ে আলাদা লেখার? কেন আপনি পুরুষদের কাজ রেখে নারীদের কাজ নিয়ে বই লিখছেন, তাঁদের উৎসাহিত করছেন? বাদ দেন এই কাজ। পুরুষদের কাজ থেকেই তো সব ফতোয়া ও ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব!’ কী অকৃতজ্ঞতা!
দ্বিতীয়ত আরেকটি উদাহরণ দিতে চাই। জেনে থাকবেন, হাদিস বর্ণনাকারীদের একটি ধারাবাহিকতা আছে। যখন এটি বর্ণনাকারী থেকে রাসুল (সা.) পর্যন্ত যেতে কমসংখ্যক মানুষের উল্লেখ করে, তার অর্থ হচ্ছে হাদিসটি বিশুদ্ধতার বিচারে উঁচুতে আছে।
হাদিস শাস্ত্রের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মর্যাদার বিশুদ্ধ হাদিস এসেছে নারীদের কাছ থেকে। ইমাম বুখারি মৃত্যুবরণ করেন ২৫৬ হিজরিতে। তাঁর পরের ১ হাজার ২০০ বছরে দেখুন, একজন বর্ণনাকারী ও ইমাম বুখারির মধ্যে মাত্র রয়েছেন ১৪ জন। এর মধ্যে রয়েছেন নারীরা। ভেবে দেখুন, কী গুরুত্বপূর্ণ তাঁদের বর্ণনাগুলো।
উম্মু দারদা নামের অপর এক নারী মক্কা ও মদিনার উভয় মসজিদে হাদিস শেখাতেন। আরও কয়েকজন নারীর কথা পেয়েছি, যাঁরা মদিনায় মসজিদে নববিতে রওজার পাশে বসে হাদিস শেখাতেন।
তাবেয়িদের প্রথম যুগে মদিনায় একটি বিচারকার্যে বিচারক এক খ্রিষ্টান চোরের শাস্তি বিধান করেছিলেন এক নারী: আ’মারা বিনতে আবদুর রহমান আস সারিয়্যাহ। তিনি একজনকে দিয়ে বিচারকের কাছে খবর দিলেন যে এ বিচার সঠিক হয়নি। হাত কাটার জন্য সুন্নাহ অনুযায়ী যে ন্যূনতম পরিমাণ সম্পদ চুরি যেতে হবে, এখানে সে পরিমাণ সম্পদ চুরি হয়নি।
উম্মু দারদা নামের অপর এক নারী মক্কা ও মদিনার উভয় মসজিদে হাদিস শেখাতেন। আরও কয়েকজন নারীর কথা পেয়েছি, যাঁরা মদিনায় মসজিদে নববিতে রওজার পাশে বসে হাদিস শেখাতেন।
এর মধ্যে একজন ফাতেমা। তাঁর ছাত্রদের বর্ণনায় আমি পেয়েছি যে তিনি রওজার একদম পাশে বসে হাদিস শেখাতেন। এমনকি মাঝেমধ্যে রওজায় হেলান দিতেন। মানুষ তাঁর কাছ থেকে হাদিস শিখতেন, ইজাজাহ নিতেন। আজ দেখুন, আমরা রওজার কাছেই ঘেঁষতে পারি না। অথচ ভাবুন, তাঁরা কত মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী ছিলেন যে তেমন জায়গায় বসতে পারতেন।
কিছুসংখ্যক নারী কাবার হাতিমে বসতেন, যেখানে এখন আমাদেরও প্রবেশাধিকার নেই। নারীরা মক্কা, মদিনা ও বায়তুল মুকাদ্দাসের অভ্যন্তরে বসে হাদিস শেখাতেন। বেথেলহেমে এক নারীর কথা আমি জেনেছি। আমি তাঁর হাদিস শেখানোর সমাবেশে উপস্থিতি হিসাব করলাম।
এটা হিজরি অষ্টম শতকের কথা, ইমাম জাহাবির সময়কার। আমি ৩৯৬ জনের বর্ণনায় তাঁর নাম পেয়েছি। যাঁদের অধিকাংশ ছিলেন পুরুষ। যিনি এই সংখ্যা গুনেছিলেন, তিনি লিখেছেন, সময়ের অভাবে আমি আর অগ্রসর হইনি। অর্থাৎ আরও তথ্য যাচাই করলে এ সংখ্যা বৃহত্তর হতো।
ভাবুন একবার, একজন নারী সিরিয়া থেকে ফিলিস্তিন এসেছেন, লোকজন তাঁর কাছ থেকে হাদিস শোনার জন্য একটি সমাবেশের আয়োজন করেছে। তাতে উপস্থিত আছে চার শতাধিক মানুষ।
আরেকজন নারীর কথা বলা যায়, জাআ বিনতু কামার। তিনি ৭৪০ হিজরিতে মৃত্যুবরণ করেন। ইমাম আজ–জাহাবি লিখেছেন, এই নারী যে গ্রন্থগুলো পড়াতেন, সেগুলোয় অসংখ্য ফিকহ সংকলিত ছিল এবং তিনি প্রায় ৪০০ বিষয়ে হাদিস শিখিয়েছেন। আমাদের সময়ের কথা ভাবুন, কতজন মানুষ এমন ১০টি হাদিসের গ্রন্থ পড়েছে?
আরেকজন নারীর কথা বলি, ফাতেমা আত–তানুহিয়্যাহ। তাঁর সংরক্ষিত সহিহ বুখারির কপিটি তুরস্কে আছে। আমি তাঁর কপিটি দেখেছি। ৮৯ বছর বয়সে তিনি যেদিন মারা যান, সেদিনও তিনি হাদিস পড়িয়েছেন।
আরেকজন নারী ফাতেমা সামারকান্দিয়্যাহ। তিনি বিয়ে করেন কাসানিকে। কাসানি হানাফি মাজহাবের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থগুলো লিখেছিলেন। ফাতেমার ফিকহের জ্ঞান কাসানির চেয়ে বেশি ছিল। কাসানির ছাত্ররা লিখেছেন, মাঝেমধ্যে তিনি ছাত্রদের প্রশ্নের জবাব দিতে অপারগতা জানাতেন। তারপর তিনি বাড়ির ভেতরে গিয়ে স্ত্রীর কাছ থেকে এর জবাব জেনে এসে ছাত্রদের জানাতেন।
কাসানি হানাফি মাজহাবের গুরুত্বপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ ‘বাদাইঊস সানাঈ’ লিখেছেন, এ কথা সর্বজনবিদিত। ভাবুন, আমাদের হানাফিদের যে বইটি একজন নারীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় লেখা, যিনি তাঁর স্বামীর চেয়ে বেশি ফিকহের জ্ঞান রাখতেন, সেই আমরা আজ নারীদেরকে জ্ঞান থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছি।
মধ্য এশিয়ার স্কলারদের নিয়ে লেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক ছিলেন আবদুল কাদের আল–কোরেশী। তিনি লিখেছেন, এ অঞ্চলের কোনো আলেমের ঘর থেকে যখন ফতোয়া আসত, এতে ঘরের পুরুষ সদস্যের পাশাপাশি তাতে তাঁর বোন, স্ত্রী কিংবা মেয়েদের স্বাক্ষর থাকত। অর্থাৎ প্রতিটি ঘরে ফতোয়া দেওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন নারীরা ছিলেন। ভেবে দেখুন, ইতিহাসকে আরও কত গভীরে গিয়ে জানতে হবে আমাদের!
ইবনে নাজ্জার, যিনি সপ্তম হিজরি শতকের শুরুর দিকে কাজ করেছেন। তিনি লিখেছেন, একেকজন নারীর সূত্রে একাধারে ৪০০ জন নারীও হাদিস বর্ণনা করেছেন। আমার বইয়ে এই বিপুলসংখ্যক নারীর খুব কমসংখ্যকের কাজই উঠিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
আমি আমার গবেষণায় যা পেয়েছি, প্রথম তিন হিজরি শতকে প্রচুর নারীরা হাদিসচর্চায় এগিয়ে এসেছিলেন। চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে খুব অল্প কাজ পাওয়া যায়। আবার ষষ্ঠ থেকে অষ্টম হিজরিতে ব্যাপক কাজ দেখা যায়। শেষ ৩০০ বছরে আবার এই পরিমাণ কমে এসেছে।
কাসানির ছাত্ররা লিখেছেন, মাঝেমধ্যে তিনি ছাত্রদের প্রশ্নের জবাব দিতে অপারগতা জানাতেন। তারপর তিনি বাড়ির ভেতরে গিয়ে স্ত্রীর কাছ থেকে এর জবাব জেনে এসে ছাত্রদের জানাতেন।
একটি প্রশ্ন আসে, তৃতীয় শতকের শেষে কেন এই নারীদের সংখ্যা কমে এসেছে?
জবাব হিসেবে বলা যায়, এ সময়ে ইসলামি জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র আরব থেকে সেন্ট্রাল এশিয়ায় স্থানান্তরিত হচ্ছিল। মধ্য এশিয়া থেকে যে ছাত্ররা আসতেন, তাঁরা নারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি পেতেন না। কেবল পুরুষদের কাছ থেকে হাদিস শিখতেন। ইমাম বুখারির শিক্ষক, ইব্রাহিম আলা ফারাহদি বলেন, আমি শুধু বসরাতেই ৭০ জন নারীর সঙ্গে হাদিস শিক্ষা করেছি। অথচ বুখারি সেই নারীদের কারোর কাছে হাদিস শেখার সুযোগ পাননি। সুতরাং সেন্ট্রাল এশিয়ান নারীরাও এ চর্চা থেকে বঞ্চিত ছিলেন।
ষষ্ঠ হিজরিতে ক্রুসেড ইত্যাদি কারণে সিরিয়া হাদিস শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে এবং তখন আমরা আবার নারীদের মধ্যে হাদিসচর্চা হতে দেখি। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম হিজরিতে এ জন্য বিপুলসংখ্যক নারীর নাম পাওয়া যায়। আপনি জানবেন, মিসরে হাদিসের চর্চা শুরুই হয় সেখানে আসা নারীদের মাধ্যমে। পরবর্তী সময় মিসর হাদিসচর্চার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
এরপর দশ শতকে আবার হিজাজে এ চর্চা শুরু হয়। সুতরাং হাদিস শেখানো যখনই কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে, নারীদের কাজগুলো আমাদের চোখে বেশি পড়ে। কিন্তু যখন হাদিসের দর্শন নিয়ে চর্চাকারীদের আমরা দেখি, খুব কম নারীকেই সেখানে পাই। কারণ, আমাদের দার্শনিকেরা ভাবতেন, নারীরা আসলে দর্শনচর্চার জন্য উপযুক্ত নন।
অ্যারিস্টটল যেমন নারীদের খুব অবমাননা করেছেন, গাজ্জালিও নারীকে অবজ্ঞা করেছেন। তিনি বলেন, কোনো নারীর সঙ্গে পরামর্শ যেন করা না হয়। করলেও নারী যা পরামর্শ দেবে, তার উল্টোটা যেন করা হয়। এমনকি তিনি এটাও বলেন যে সব সমস্যার মূলে হলো নারী।
এখানে একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন। আমি কেবল আমার পাওয়া কিছু তথ্যের ভিত্তিতে এসব তুলে ধরেছি। আমাদের আরও অনেক জানতে হবে এবং তথ্য–প্রমাণ লাগবে। হয়তো এমন তথ্যও আমরা পাব, যাতে এত দিন ধরে আমরা যা ভেবে আসছি, তার বিপরীত চিত্র ফুটে উঠবে।