২০২৫ এশিয়া কাপকে ক্রিকেটপ্রেমীরা আলাদাভাবে মনে রাখবে
২০২৫ এশিয়া কাপকে ক্রিকেটপ্রেমীরা আলাদাভাবে মনে রাখবে

রাজনৈতিক এশিয়া কাপ খেলার মাঠকেও বানিয়ে দিয়েছে অসুস্থ রাজনীতির ময়দান

কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহতের ঘটনার পর অন্য অনেক বিষয়ের মতো এশিয়া কাপেও অস্থিতিশীলতার হাওয়া লাগে। পাকিস্তানের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্নের যে আওয়াজ ওঠে ভারতে, তাতে ঢুকে যায় খেলায় কখনো মুখোমুখি না হওয়ার দাবিও।

সাকল্যে ১৬ মিনিটের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। ভারতের অভিষেক শর্মা টুর্নামেন্ট–সেরার পুরস্কার হাতে কথা শেষ করে চলে যেতেই সঞ্চালক নিউজিল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার সাইমন ডুলের আচমকা ঘোষণা—‘এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল (এসিসি) জানিয়েছে, ভারত আজ ট্রফি নেবে না।’

রোববার মধ্যরাতে দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সাক্ষী হলো নজিরবিহীন এক ঘটনার। চ্যাম্পিয়ন দল ট্রফি নেয়নি! তবে কিছুক্ষণ পর অতিথিবিহীন মঞ্চে দেখা গেল মিছেমিছি এক ট্রফি উদ্‌যাপন। ২০২৫ এশিয়া কাপের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে উল্লাস করলেন সূর্যকুমার যাদব–হার্দিক পান্ডিয়ারা। যে উদ্‌যাপনে আলোকফোয়ারা ছিল, গ্যালারির এক কোণে দর্শকের হইহল্লা ছিল। ছিল না শুধু ট্রফি।

পাকিস্তানকে ৫ উইকেটে হারিয়ে এশিয়া কাপ জিতলেও ভারত কেন ট্রফি নেয়নি, তা এরই মধ্যে সবার জানা। নিয়ম অনুযায়ী ট্রফি দেওয়ার কথা টুর্নামেন্টের আয়োজক এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের (এসিসি) প্রধান মহসিন নাকভির, যিনি আবার পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) চেয়ারম্যান এবং দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। নাকভির রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণেই তাঁর কাছ থেকে ট্রফি না নেওয়ার সিদ্ধান্ত ভারতের।

ট্রফি ছাড়াই উদ্‌যাপন করেছে ভারত

খেলার মাঠে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। ম্যাচ শেষে গত মে মাসে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পরিচালিত ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামের সামরিক অভিযানের প্রসঙ্গ টেনে তাঁর টুইট, ‘খেলার মাঠেও অপারেশন সিঁদুর। ফলাফল একই—ভারতের জয়! অভিনন্দন আমাদের ক্রিকেটারদের।’

উত্তর দিতে দেরি করেননি মহসিন নাকভিও। মোদির পোস্ট রিটুইট করে তিনি লিখেছেন, ‘যদি যুদ্ধই তোমার গর্বের মাপকাঠি হয়, তবে ইতিহাস এরই মধ্যে পাকিস্তানের হাতে তোমার লজ্জাজনক পরাজয়ের কথা লিখে রেখেছে। কোনো ক্রিকেট ম্যাচ সেই সত্যকে বদলাতে পারবে না। খেলায় যুদ্ধ টেনে আনা শুধু হতাশাকে প্রকাশ করে আর খেলার মূল চেতনাকেই কলঙ্কিত করে।’

দুই রাজনীতিবিদের এই পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের সুরই এখন ভারত ও পাকিস্তান ক্রিকেটের নিদারুণ বাস্তবতা। যেটি খেলার মাঠকেও বানিয়ে দিয়েছে অসুস্থ রাজনীতির ময়দান।

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এশিয়া কাপ

ক্রিকেটে সবচেয়ে অর্থকরী ম্যাচ ধরা হয় ভারত–পাকিস্তান ম্যাচকেই। আইসিসিই যেমন তাদের টুর্নামেন্টে ভারত–পাকিস্তানের মুখোমুখি হওয়া নিশ্চিত করতে দুই দলকে একই গ্রুপে রাখে। এশিয়া কাপেও একই সমীকরণ। ২০১২–১৩ মৌসুমের পর দুই দেশ দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলে না বলে আইসিসি বা এসিসির টুর্নামেন্টে এই দুটি দলের অন্তত দুটি ম্যাচের অঙ্ক কষে রাখা হয়।

গত এপ্রিলে পেহেলগাম হামলাকে কেন্দ্র করে ভারত–পাকিস্তানের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকে

তবে গত এপ্রিলে ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহতের ঘটনার পর অন্য অনেক বিষয়ের মতো এশিয়া কাপেও অস্থিতিশীলতার হাওয়া লাগে। পাকিস্তানের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্নের যে আওয়াজ ওঠে ভারতে, তাতে ঢুকে যায় খেলায় কখনো মুখোমুখি না হওয়ার দাবিও।

গত মে মাসের শুরুতে ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে পাকিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করলে পাকিস্তানও পাল্টা হামলা চালায়। তাতে এশিয়া কাপই হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। দুই দেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট আইপিএল আর পিএসএলও স্থগিত হয়ে যায় তখন।

ওই ঘটনার পর সৌরভ গাঙ্গুলী, গৌতম গম্ভীরের মতো ভারতের সাবেক ক্রিকেটাররা খোলামেলাভাবেই পাকিস্তানের সঙ্গে খেলাধুলা বন্ধের দাবি তোলেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ‘ভারত এশিয়া কাপে খেলবে না’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বিসিসিআইয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, এসিসির প্রধান একজন পাকিস্তানি মন্ত্রী, তাঁর আয়োজন করা এশিয়া কাপে ভারত খেলবে না।

এশিয়া কাপ নিয়ে ভারতের কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসার অন্যতম কারণ সম্প্রচারকদের চাপ। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এসিসির সঙ্গে পরবর্তী চারটি এশিয়া কাপের সম্প্রচার স্বত্বের চুক্তি করে সনি স্পোর্টস নেটওয়ার্ক। ১৭ কোটি মার্কিন ডলারের সেই চুক্তির অলিখিত শর্ত ছিল প্রতিটি আসরে অন্তত দুটি ভারত–পাকিস্তান ম্যাচের ব্যবস্থা রাখা।

এশিয়া কাপের সম্প্রচার স্বত্ব কিনেছে সনি স্পোর্টস নেটওয়ার্ক

পারস্পরিক স্বার্থ থাকায় সনি স্পোর্টস নেটওয়ার্কের আয়ে ক্ষতি হওয়া মানে বিসিসিআইয়েরও ক্ষতি। শেষ পর্যন্ত ভারতীয় বোর্ড তাই এশিয়া কাপ নিয়ে ইতিবাচক পথেই হাঁটে। দুই দেশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ভারতের এশিয়া কাপ হয় আমিরাতে।

আপত্তি ভারতেরই বেশি

গত জুলাইয়ে সাবেক ক্রিকেটারদের নিয়ে যুক্তরাজ্যে আয়োজিত হয় ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ অব লিজেন্ডস। অংশগ্রহণকারী ছয় দলের মধ্যে ছিল ভারত, পাকিস্তানের লিজেন্ডস দলও।

কিন্তু বেসরকারিভাবে আয়োজিত এই টুর্নামেন্টেও পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ খেলতে অস্বীকৃতি জানান ভারতের শিখর ধাওয়ান, হরভজন সিং, ইউসুফ পাঠানসহ কয়েকজন সাবেক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার। সেই ম্যাচ তো শেষ পর্যন্ত হয়ইনি, এমনকি সেমিফাইনালে মুখোমুখি হওয়ার কথা থাকলেও সেখানেও ওয়াকওভার দেয় ভারত।

ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ অব লিজেন্ডস টুর্নামেন্টে পাকিস্তানের বিপক্ষে দুটি ম্যাচই বর্জন করে ভারত

সাবেকদের টুর্নামেন্টে পাকিস্তানের মুখোমুখি হতে না চাওয়া হরভজন এশিয়া কাপ নিয়েও বিরোধী অবস্থান নেন। সীমান্তে গোলাগুলি চলে, খেলা কীভাবে হয়—এমন প্রশ্ন তোলেন তিনি। এই হরভজন কদিন আগে বিসিসিআই সভাপতি পদে অন্যতম প্রার্থী ছিলেন। মনোজ তিওয়ারি, কেদার যাদবের মতো সাবেক ক্রিকেটাররাও এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলা নিয়ে নিয়মিত আপত্তি তুলতে থাকেন।

তবে গত ২১ আগস্ট ভারত সরকারের ক্রীড়া মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে জানায়, নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকিতে না পড়তে ভারত আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা চালিয়ে যাবে, কিন্তু দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে খেলবে না। দীর্ঘদিন ধরে ভারত–পাকিস্তান নিজেদের মধ্যে না খেললেও এটিই ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম নীতিগত অবস্থান প্রকাশের ঘটনা। পাকিস্তান অবশ্য ভারতের সঙ্গে খেলা নিয়ে বরাবরই ইতিবাচক অবস্থানে থাকে।

এবার শুরু হাত না মেলানো দিয়ে

এবার দুবাইয়ের এশিয়া কাপে ভারত–পাকিস্তান প্রথম মুখোমুখি হয় ১৪ সেপ্টেম্বর। সেদিন টসের সময় পাকিস্তান অধিনায়ক সালমান আগার সঙ্গে হাত মেলাননি ভারত অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব। ম্যাচ শেষ হওয়ার পর দুই দলের খেলোয়াড়দের হাত মেলানোর রীতিও মানেনি ভারত, খেলা শেষ হতে তাদের ড্রেসিংরুমের দরজাও বন্ধ করে দেওয়া হয়।

ভারত অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব পরে বলেছেন, ভারত সরকার ও বিসিসিআইয়ের অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই তাঁদের এই সিদ্ধান্ত। গত মে মাসে পাকিস্তানে চালানো ভারতের সামরিক অভিযানের প্রসঙ্গও টেনেছিলেন তিনি।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর এশিয়া কাপের ম্যাচ শেষে পাকিস্তানের কেউ যেন দেখা করতে না পারেন, তাই ড্রেসিংরুমের দরজা বন্ধ করে দেয় ভারতীয় দল

হাত না মেলানো ক্রিকেটের আবশ্যকীয় কোনো শর্ত নয়। যে কারণে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) ক্ষুব্ধ হলেও ভারতকে দায়ী করে কিছু বলতে পারেনি। তবে টসের আগে ম্যাচ রেফারি অ্যান্ডি পাইক্রফটই পাকিস্তান অধিনায়ক সালমান আগাকে ‘হাত মেলাবে না’ বার্তা জানানোয় তাঁকে কাঠগড়ায় তোলে পিসিবি। এশিয়া কাপ থেকে অপসারণ চেয়ে বসে পাইক্রফটের, এমনকি টুর্নামেন্ট থেকে সরে যাওয়ার হুমকিও দেয়।

কিন্তু ম্যাচ রেফারির নিয়োগকর্তা আইসিসি সে দাবি প্রত্যাখ্যান করে। এ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে বেশ উচ্ছ্বাসও দেখা যায় কারণ, দুই ভারতীয়ই পাকিস্তানের দাবি আটকে দিয়েছেন। দুই ভারতীয় বলতে আইসিসি চেয়ারম্যান জয় শাহ (বিসিসিআইয়ের সাবেক সচিব ও ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর ছেলে) এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সঞ্জোস গুপ্ত।

এশিয়া কাপের মাঝপথে ম্যাচ রেফারি অ্যান্ডি পাইক্রফটের অপসারণ দাবি করে পাকিস্তান

সাধারণত, গ্রুপ পর্বের খেলা শেষে পরের পর্বের জন্য ম্যাচ রেফারির তালিকা চূড়ান্ত করে আইসিসি। পরে দেখা যায়, ২১ সেপ্টেম্বর ভারত–পাকিস্তান সুপার ফোর পর্বের ম্যাচেও পাইক্রফটকেই রেফারির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ নিয়েও বেশ ক্ষুব্ধ হয় পিসিবি।

সেদিন মাঠের খেলায় পাকিস্তানি পেসার হারিস রউফ হাত দিয়ে বিমান ভূপাতিত এবং আঙুল দিয়ে ‘৬–০’ ইশারা করেন, যা মে মাসে দুই দেশের সংঘাতে পাকিস্তান কর্তৃক ভারতের ৬টি বিমান ভূপাতিতের দাবিকেই ইঙ্গিত করে।

ভারত এ নিয়ে আইসিসিতে অভিযোগ জানালে পাকিস্তানও সূর্যকুমারের মন্তব্য নিয়ে আরেকটি অভিযোগ দেয়। রাজনীতির সেই ছায়া তিন দিন পর নাকভির টুইটেও ফুটে ওঠে।

পর্তুগালের তারকা ফুটবলার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর বিমান ভূপাতিতের একটি উদ্‌যাপনের ভিডিও শেয়ার দিয়ে তিনিও জড়ান একই বিতর্কে। এরপর আইসিসি রউফকে তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য ম্যাচ ফির ৩০ শতাংশ জরিমানা করলে নাকভি সেটা নিজের ব্যক্তিগত পকেট থেকে পরিশোধ করার ঘোষণা দেন।

ভারত–পাকিস্তানের রাজনৈতিক বৈরিতার ঢেউ এবারের এশিয়া কাপে প্রবলভাবে আঘাত করেছে

এসব রাজনৈতিক ডামাডোলের ঢেউই প্রবলভাবে আঘাত করেছে কাল রাতের এশিয়া কাপ ফাইনালে। ভারত নাকভির হাত থেকে ট্রফি নেবে না, নাকভিও অন্য কারও হাত দিয়ে ট্রফি দিতে দেবেন না। ফলাফল—১৭তম এশিয়া কাপের চ্যাম্পিয়ন দল স্টেডিয়াম ছেড়েছে ট্রফি ছাড়াই।

আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে ভারত ও পাকিস্তানের দুই অধিনায়কই বলেছেন—এমন কিছু তাঁরা আগে দেখেননি। দেখেনি আসলে কেউই।