গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

মনীষাভ্রমণ

ম্যাক্সিম গোর্কির আবাসস্থলে

মস্কোর আকাশে আজ মেঘ ঘনিয়েছে। সকাল থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। এমনিতে গরমকাল, তবে বৃষ্টি পড়ার কারণে ঠান্ডা জাঁকিয়ে বসছে। মস্কোতে আমার দিনগুলো উড়ে উড়ে পার হয়ে যাচ্ছে। অল্প দিন হাতে আছে রাশিয়ায়। এর মাঝে কত কিছু যে দেখার বাকি!

আমি এসেছিলাম আলেক্সেই মাক্সিমোভিচ পেশকভের বাড়িতে। রাশিয়ার বিখ্যাত এই লেখক পাঁচবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েও পুরস্কার জেতেননি। এমন অসামান্য লেখকের প্রাসাদতুল্য বাড়ির সামনে এসে দেখি দুয়ার তালাবদ্ধ। আজ আর দুয়ার খুলবে না। দোতলা এই বাড়িটিতে লেখক জীবনের শেষ কয়েক বছর বসবাস করেছিলেন। বাড়ির সামনে প্রশস্ত আঙিনা। সেখানে উঁচু উঁচু গাছ অন্য পাশ থেকে বাড়িকে ঢেকে দিয়েছে। বাড়ির চারপাশ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।

প্রাচীন এই বাড়ির আশপাশে ঘুরেফিরে আবার ফিরে গেলাম। আজ তিনি দুয়ার না খুললে কাল নিশ্চয়ই খুলবেন। রাশিয়ার অন্যান্য বিখ্যাত লেখকের বাড়ির মতো তাঁর বাড়িটিকেও মিউজিয়াম করে রাখা হয়েছে। ঊনবিংশ শতকে রাশিয়ায় জনপ্রিয়তা পেলেও আমাদের বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে তিনি আজ অবধি সবচেয়ে জনপ্রিয় রুশ লেখক।

আগের দিন লেখকের হাউস মিউজিয়াম বন্ধ ছিল। তাই দুয়ার থেকে ফিরে যেতে হয়েছিল। কিন্তু আমি হচ্ছি বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী ধরনের মানুষ। এত সহজে এ বাড়ি না দেখে আমি মস্কো ছাড়ব না।

আলেক্সেই মাক্সিমোভিচ পেশকভের বয়স যখন চব্বিশ তখন এক পত্রিকায় লেখা পাঠানোর সময় আলেক্সেই লেখকের নামে নিজের নাম লেখেন ‘ম্যাক্সিম গোর্কি’। রুশ ভাষায় ম্যাক্সিম শব্দের অর্থ—তিক্ত। জীবনের কঠিন বাস্তবতা আর তিক্ততার স্বাদ অল্প বয়সে গ্রহণ করায় তিক্ত নামেই পরবর্তীকালে তিনি বিখ্যাত হয়েছেন।

আলেক্সেই মাক্সিমোভিচ পেশকভ ১৮৬৮ সালে রাশিয়ার নিঝনি নভোগরদ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। এগারো বছর বয়সে অনাথ হয়ে যাওয়ার পর দিদিমা তাঁকে সঙ্গে নিয়ে রাখেন। কিন্তু বারো বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে পালান। এরপর বছর পাঁচেক রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ান। কখনো পেট চালানোর জন্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজ করতে হয়েছে। পথেই থাকতে হয়েছে। এ সময়ে আলেক্সেই মুচির কাজও করেছিলেন।

ম্যাক্সিম গোর্কির বাড়ি

রাশিয়ার পথে পথে ঘুরে ঘুরে পেট চালানোর জন্য নানা কাজ করে নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।

জাহাজে কয়েদিদের বাসন মাজার কাজ করার সময় তাঁর হাতে আসে পুশকিনের একটি বই। তখন থেকে সাহিত্য পড়ার নেশায় পেয়ে বসে, জীবনের শেষ দিন অবধি সেই নেশা কাটেনি।

কুড়ি বছর বয়সে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। নিজের পিস্তলের গুলিতে গুরুতর আহত হলেও অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে ফিরে আসেন। দ্বিতীয় জীবন ফিরে পাওয়ার পর তিনি সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য শাখার বই পড়তে শুরু করেন এবং সাহিত্যচর্চাও জারি রাখেন। এ সময়ই তিনি মার্ক্সবাদের ভক্ত হয়ে ওঠেন।

বয়স যখন চব্বিশ তখন এক পত্রিকায় লেখা পাঠানোর সময় আলেক্সেই লেখকের নামে নিজের নাম লেখেন ‘ম্যাক্সিম গোর্কি’। রুশ ভাষায় ম্যাক্সিম শব্দের অর্থ হলো—তিক্ত। জীবনের কঠিন বাস্তবতা আর তিক্ততার স্বাদ অল্প বয়সে গ্রহণ করায় তিক্ত নামেই পরবর্তীকালে তিনি বিখ্যাত হয়েছেন।

ম্যাক্সিম গোর্কির ব্যবহৃত টেলিফোন

এর কিছুদিন পর সাংবাদিকতার প্রস্তাব পান এবং সাংবাদিক হিসেবে যোগদান করেন। সঙ্গে সাহিত্যচর্চা করেন পুরোদমে। রাশিয়ান জারদের কঠোর সমালোচনা করার কারণে তোপের মুখে পড়ে কয়েকবার জেল খাটতে হয়। নিজেকে ভেঙে ফের গড়ে নেওয়ার মানুষ ম্যাক্সিম গোর্কি। লিও তলস্তয়, আন্তন চেখভের ভালো বন্ধু ছিলেন। মহামতি লেলিনও তাঁকে সুনজরে দেখতেন। লেনিন তাঁকে রুশ সাহিত্য রক্ষার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেন। এত দিন নিজ উদ্যোগে বিভিন্নভাবে রুশ সাহিত্যে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। কিছু দায়িত্ব প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এবার পেলেন। আগে পদ–পদবি ছাড়াই রুশ সাহিত্যে তিনি অনেক অবদান রেখেছিলেন; কিন্তু এবার স্বীকৃতি পেয়ে মূল্যবান শিল্প-সাহিত্যের বিষয় সংরক্ষণ, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিকদের জীবন রক্ষা, বিশ্বসাহিত্য প্রকাশনা সংস্থা গঠনের মতো কাজ পুরোদমে করতে থাকেন।

নিজেকে ভেঙে ফের গড়ে নেওয়ার মানুষ ম্যাক্সিম গোর্কি। লিও তলস্তয়, আন্তন চেখভের ভালো বন্ধু ছিলেন। মহামতি লেলিনও তাঁকে সুনজরে দেখতেন। লেনিন তাঁকে রুশ সাহিত্য রক্ষার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেন। এত দিন নিজ উদ্যোগে বিভিন্নভাবে রুশ সাহিত্যে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।

সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ম্যাক্সিম ক্ষমতাবানদের সমালোচনা করতেন। তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রও করা হয়েছিল বিস্তর। সে কারণে অনেকটা সময় দেশ ছেড়ে পালিয়ে থাকতে হয়েছে। বলতে গেলে লেনিন প্রায় জোর করেই দেশছাড়া করেন তাঁকে। বিদেশের মাটিতেও রাশিয়ার বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক ও বিপ্লবীদের পক্ষে লিখে সংগ্রাম চালিয়ে যান।

১৯০৬ সালে আমেরিকায় অবস্থানকালে লেখেন কালজয়ী উপন্যাস ‘মা’। প্রথমে উপন্যাসটি ইংরেজি অনুবাদে আমেরিকা থেকে প্রকাশিত হয়। এরপর রুশ ভাষায় ১৯০৭ সালে প্রকাশিত হয়। ম্যাক্সিম গোর্কি সাধারণত নিজের আত্মজীবনী নিয়েই লিখেছেন। ‘মা’ উপন্যাস বা ‘নিচুতলা’ বা ‘ঝরোপাখির গান’ রচনাগুলোর মধ্য দিয়ে তাঁর লেখায় এক নতুন ধারা যুক্ত হয়।

দ্বিতীয়বারের মতো দেশে ফিরে আসার পর তাঁকে মস্কোতে একটি রাজকীয় বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। স্টালিন তাঁকে রাজকীয় সংবর্ধনা দিয়ে দেশে ফেরান ঠিকই; তবে এখানেও একটা রাজনৈতিক চাল ছিল। স্টালিন বোঝাতে চাইছিলেন—লেনিন এই ক্ষুরধার সাহিত্যিককে দেশছাড়া করেছেন আর আমি তাঁকে দেশে এনে উচ্চ আসনে বসিয়েছি। গোর্কিকে বিলাস-ব্যসনে ডুবিয়ে রাখা হয়েছিল, যাতে প্রলেতারিয়েতদের কষ্টের কাছে যেতে না পারেন। জীবিতকালেই তাঁর নামে সড়ক, পার্ক, ইনস্টিটিউট, জন্মস্থানের নামকরণ করা হয়। সোভিয়েত লেখক সংঘের প্রধান করা হয় তাঁকে।

ম্যাক্সিম গোর্কির লেখাপড়ার ঘর

একজন সফল লেখক, নাট্যকার হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পর যখন অর্থবিত্তের কমতি ছিল না, তখন তিনি দুহাত ভরে রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টিকে সহায়তা করেছেন।

ম্যাক্সিম গোর্কি মার্ক্স ও বলশেভিক বিপ্লবী ছিলেন। সাহিত্যচর্চার সঙ্গে সঙ্গে দেশ নিয়েও ভাবনার অন্ত ছিল না। তবে স্টালিনের সময়ে তাঁকে মুখ খুলতে দেওয়া হয়নি। স্টালিনের সঙ্গে সদ্ভাব থাকলেও পরবর্তীকালে মৃত্যুর আগের দুই বছর গোর্কিকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। এ সময় বহু বিপ্লবীর কণ্ঠরোধ করে রাখা হয়েছিল বা হত্যা করা হয়েছিল। গোর্কি নিজের অবস্থা সম্পর্কে ভালোভাবেই ওয়াকিবহাল ছিলেন। জানতেন, যে সোনার খাঁচায় তাঁকে পুরে রাখা হয়েছে, তা থেকে নিস্তার পাওয়ার উপায় নেই।

১৯৩৬ সালে ম্যাক্সিম গোর্কির দেহাবসান ঘটলে মস্কোতে খুব সাধারণভাবে তাঁকে সমাহিত করা হয়। গোর্কির মৃত্যু নিওমোনিয়ায় ঘটলেও অনেকে সন্দেহ করেন যে তাঁকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। মৃত্যুর আগে তিনি লিখেছিলেন, ‘ওরা বলে নিউমোনিয়া। আমি জানি মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে।’ তিনি কি তবে টের পেয়েছিলেন যে তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে?

বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের নামীদামি ডিগ্রি ছাড়া, পথে পথে ঘুরে নিজের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে গল্প–উপন্যাস লিখে জনগণের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়ে, নিজের মতো করে বেঁচেছিলেন লেখক ম্যাক্সিম গোর্কি।

ম্যাক্সিম গোর্কির বাড়ির সিঁড়িতে লেখক

ম্যাক্সিম গোর্কির বাড়িটি বিশাল এক জমিদারবাড়ি যেন। আজ দ্বিতীয়বার এসে দেখি বাড়ির দুয়ার খুলতে আরও কয়েক মিনিট বাকি। আমি বাড়ির সামনে পথের ধারের বেঞ্চে বসে থাকি। এর মাঝে টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মাথার ওপরে গাছ থাকায় বৃষ্টির ছাট এসে গায়ে পড়ছে না। এর মাঝে দুজন আমার সামনে ট্যাক্সি থেকে নামলেন। আমার মনে হলো তাঁরা গোর্কিকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন। জিজ্ঞেস করতেই হ্যাঁ বললেন। মেয়েটির নাম লিজা আর মায়ের নাম সোয়েতলানা। আমি চাইছিলাম ওদের সঙ্গে গোর্কি মিউজিয়ামে ঢুকতে। লিজা ইংরেজি জানে। কাজান শহরে বসবাস করেন তাঁরা। সোয়েতলানা পেশায় একজন সাংবাদিক শুনে আমি লাফিয়ে উঠলাম। ম্যাক্সিম গোর্কির শেষ দিনগুলো সম্পর্কে নিশ্চয়ই অনেক কিছু জানতে পারব।

১৯০৬ সালে আমেরিকায় অবস্থানকালে লেখেন কালজয়ী উপন্যাস ‘মা’। প্রথমে উপন্যাসটি ইংরেজি অনুবাদে আমেরিকা থেকে প্রকাশিত হয়। এরপর রুশ ভাষায় ১৯০৭ সালে প্রকাশিত হয়। ম্যাক্সিম গোর্কি সাধারণত নিজের আত্মজীবনী নিয়েই লিখেছেন। ‘মা’, ‘নিচুতলা’, ‘ঝরোপাখির গান’ রচনাগুলোর মধ্য অন্যতম।

পথের ধারে মিউজিয়ামের যে দুয়ার, সেটি এখনো বন্ধ দেখে অবাক হলাম। কারণ, রুশি জনগণের সময়ানুবর্তিতা কিংবদন্তিতুল্য। সোয়েতলানা আমাদের বাড়ির পেছনের দিকে নিয়ে গেল। সেখানে আরেকটি দরজা আছে, যা মিউজিয়ামে প্রবেশের দরজা। এই দরজার কাছে আসতেই এক টুকরো রোদ গায়ে মেখে আকাশ ঝলমল করে উঠল। আর আকাশও দেখি নীল জামা পরে খুব হাসছে।

টিকিটঘরের নারীটি বললেন, ‘এখানে বিদেশি তেমন আসে না। তুমি এলে, অনেক দিন পর একজন বিদেশি দেখলাম।’ টিকিটঘরের বাকি দুজন এমনভাবে আমার সঙ্গে কথা বলছিল যেন আমি তাদের রাজকীয় অতিথি। আমার তর সইছিল না, কখন যে আলেক্সেইয়ের বাড়ির ভেতরে যাব!

বাড়িতে ঢুকতে প্রথমেই পড়ল দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ি। সিঁড়িটি শ্বেতপাথরে নির্মিত। নিচতলায় আলেক্সেইয়ের কক্ষগুলো আগে দেখতে হবে। প্রথম কক্ষে প্রবেশের আগে কক্ষের দরজা দেখে মাথা ঘুরিয়ে গেল। দামি মেহগনি কাঠের দরজা আর তার হাতলের নকশা একেবারে ভিন্ন ডিজাইনের। হাতল দেখে মনে হচ্ছে পিতলের তৈরি কোনো শোপিস।

ম্যাক্সিম গোর্কির সংগ্রহের আইভরির মিনিয়েচার শোপিস

প্রথম কক্ষটি ছিল ম্যাক্সিম গোর্কির খাবার ঘর। বাড়ির আকারের মতো খাবার ঘরটির আকারও বিশাল। দশ সিটের একটি ডাইনিং টেবিল আর ডাইনিং টেবিলের এক পাশের দেয়ালে, দেয়াল জোড়া কাবার্ড। সেখানে গোর্কির ব্যবহৃত কাচের ক্রোকারিজ রাখা। এর পাশে একটি কর্নার টেবিলের সামোভার রাখা। কক্ষের আরেক পাশে লম্বাভাবে বিশাল এক সেট সোফা পাতা। খাবার টেবিলের ওপর ল্যাম্প ঝুলছে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো এ কক্ষের জানালা। জানালার ফ্রেমের ডিজাইন একেবারে আলাদা। জানালার শোভা বাড়ানোর জন্য ডিজাইন করা কাঠের ফ্রেম বসানো আর জানালার ওপরের দেয়ালে ইস্পাতের পাত দিয়ে নকশা করা। জানালার বাইরে সবুজ গাছ জানালাকে সবুজ রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। পাশেই একটা পিয়ানো রাখা। পিয়ানো তখনকার দিনে প্রায় সব অবস্থাসম্পন্ন ঘরে থাকত। এ কক্ষের মেঝে কাঠের ও দেয়ালেও কাঠ দিয়ে একধরনের আচ্ছাদন দেওয়া আছে।

দ্বিতীয়বারের মতো দেশে ফিরে আসার পর তাঁকে মস্কোতে একটি রাজকীয় বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। স্টালিন তাঁকে রাজকীয় সংবর্ধনা দিয়ে দেশে ফেরান ঠিকই; তবে এখানেও একটা রাজনৈতিক চাল ছিল। স্টালিন বোঝাতে চাইছিলেন—লেনিন এই ক্ষুরধার সাহিত্যিককে দেশছাড়া করেছেন আর আমি তাঁকে দেশে এনে উচ্চ আসনে বসিয়েছি।

পরের কক্ষটি লেখকের বসার ঘর। বসার ঘরে প্রবেশের দরজার কাঠে ফুল লতা খোদাই করা আর দরজার ওপরের অংশে কাচ বসানো। দরজার হাতলে ভিন্ন নকশা। বিলাসবহুল এই বসার ঘরটিতে চামড়ায় মোড়া পুরু গদির বিশাল আকারের এক সেট সোফা আছে। সোফা সেটটি গোল করে কক্ষে সাজানো। আর এর সামনে রাখা গোলাকার একটি টেবিল ও কয়েকটি চেয়ার। দুপাশের দেয়ালে প্রায় ছাদ অবধি কাচ দিয়ে ঘেরা কাঠের শেলফে বই রাখা। জানালায় খাবার ঘরের মতোই ফ্রেমে নকশা করা। এ কক্ষের সবচেয়ে নান্দনিক অংশ হলো এর সিলিং। সিলিংয়ে সিমেন্টের ওপর খোদাই করে ফুল লতার নকশা কাটা। জানালার কাছের অংশে আকাশি আর হালকা সবুজ রং দিয়ে ফুল আর আকাশ আঁকা। লেখক এ কক্ষে দেশের বিখ্যাত লেখক ও বরেণ্য ব্যক্তিদের সঙ্গে বসে বিভিন্ন আলোচনা করতেন। এ ছাড়া এখানে বসে তিনি বই পড়তেন। এ কক্ষের এক কোনায় এ বাড়িতে ব্যবহার হতো এমন তিনটি টেলিফোন রাখা আছে। টেলিফোনগুলোর গোল ডায়ালে আঙুল দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ডায়াল করতে হতো সে সময়।

রাজসিক এই বসার ঘর পার হলে একটা ছোট খালি কক্ষ। সে কক্ষের দেয়াল আলমারিতে কাচের ওপাশে রাখা আছে গোর্কির ওভারকোট, বুট ও ছড়ি।

ম্যাক্সিম গোর্কির ওভারকোট, বুট ও ছড়ি

এরপরের কক্ষ আমার কাছে এ বাড়ির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কক্ষ, ম্যাক্সিম গোর্কির লেখা ও পড়ার কক্ষ। কক্ষে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই দেয়ালজুড়ে জানালা চোখ পড়ল। বাইরে নীল আকাশ অর্ধগোলাকার জানালার কাচ ভেদ করে ফুটে উঠেছে। জানালার সামনে ম্যাক্সিম গোর্কির লেখার টেবিল। আয়তাকার টেবিলটি দেখতে খুব সাধারণ। টিল রঙের টেবিল ক্লথ বিছানো। টেবিলের ওপর গোর্কির ব্যবহৃত চশমা, কলম, দোয়াত, সিল, নিজের লেখা বই কাচের বাক্সে রাখা আছে। কাচের বাক্সে সব রঙের কালার পেনসিলও রাখা। নানা রঙের পেনসিল দিয়ে তিনি কী করতেন, তা জানা নেই। টেবিলের সামনে এক সিটের একটা সোফা রাখা। জীবনের শেষ চার বছর গোর্কি এই বাড়িতে বসবাস করেছিলেন এবং এই চার বছর এখানে বসেই সাহিত্য চর্চা করেছেন। যদিও আগের মতো মুক্ত-স্বাধীন অবস্থার সাহিত্যচর্চা আর করতে পারেননি।

টেবিলের পেছনে লেখকের বসার চেয়ার রাখা। এর পেছনে কাচ আর কাঠের তৈরি একটি আলমারি। সবই ঠিক আছে, তবে আলমারির কাচ পর্দায় ঘেরা। এর মর্ম ঠিক বুঝলাম না। লিজা আর সোয়েতলানা চলে গিয়েছে অন্য কক্ষে। এই কক্ষে প্রহরী ছাড়া আর কেউ নেই, তিনি ইংরেজি জানেন না।

কক্ষের দেয়ালের মাঝ বরাবর অত্যাধুনিক একটি ফায়ারপ্লেস বসানো, যা দামি পাথরে তৈরি। ফায়ারপ্লেসের ওপরের ও পাশের শোকেসে আইভরির কয়েক শ চায়নিজ মিনিয়েচার শোপিস রাখা। এই শোপিসগুলো লেখককে চীন দেশের বন্ধুরা উপহার দিয়েছিলেন এবং কিছু শোপিস লেখক নিজেও সংগ্রহ করেছিলেন।

ম্যাক্সিম গোর্কির শোবার ঘর

পরের কক্ষটি লেখকের শোবার ঘর। এই কক্ষের খোলা উদার জানালার পাশে একটি সিঙ্গেল বেড রাখা। বিছানার দুপাশে বেড সাইড টেবিল। একটা টেবিলে বেডসাইড ল্যাম্প আর পানির গ্লাস কাপড়ের ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখা। দেখে মনে হচ্ছে ম্যাক্সিম সাহেব একটু আগেই এখান থেকে উঠে চলে গিয়েছেন। কক্ষের এক পাশে একটি কাঠের আলমারি রাখা, যার গায়ে বিশাল আয়না বসানো। এ কক্ষ বা প্রতিটি কক্ষের আসবাব খুব দামি উপকরণ দিয়ে সাজানো, যা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি লড়েছিলেন জীবনের শেষ বেলায়, সে পরিবেশেই তাঁকে বাস করতে দেওয়া হয়নি।

যাঁরা এ বাড়ি দর্শনে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই এই বাড়ির সিঁড়িতে বেশি সময় কাটাচ্ছেন। সিঁড়িটি শ্বেতপাথরে নির্মিত। সিঁড়ির রেলিংয়ে খোদাই করা কারুকাজ। একই খোদাই দোতলা হয়ে চিলেকোঠায় চলে গিয়েছে। সিঁড়ির গোড়ায় বড় একটা শ্বেতপাথরের ল্যাম্প মাথার ওপর ছাতার মতো ছড়ানো আছে। সিঁড়িতে কার্পেট বিছানো। সারা জীবন সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করে, সমাজতন্ত্রের ধারকবাহক হয়ে ম্যাক্সিম গোর্কি কি এই রাজকীয় বাড়িতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরেছিলেন?

সিঁড়ির গোড়ায় বড় একটা শ্বেতপাথরের ল্যাম্প মাথার ওপর ছাতার মতো ছড়ানো আছে। সিঁড়িতে কার্পেট বিছানো। সারা জীবন সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করে, সমাজতন্ত্রের ধারকবাহক হয়ে ম্যাক্সিম গোর্কি কি এই রাজকীয় বাড়িতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরেছিলেন?

সিঁড়িতেও বইয়ের শেলফ সাজানো। তবে এখানেও আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, শেলফের কাচ পর্দা দিয়ে ঘেরা। এই রহস্য সোয়েতলানাও উদ্‌ঘাটন করতে পারল না।

দোতলায় উঠে দেখি সিঁড়ির ল্যাম্পটির ডিজাইন সাধারণ কিছু নয়। ওপর থেকে দেখলে মনে হয় এটি কচ্ছপের রঙিন পিঠ। সোয়েতলানা তাই বলছিল।

দোতলার একটিমাত্র কক্ষ খোলা আছে। সে কক্ষটির দেয়ালে বিভিন্ন সময়ে তোলা ম্যাক্সিম গোর্কির ছবি ফ্রেমে বাঁধাই করে ঝোলানো আছে। কয়েকটি হাতে আঁকা পোর্ট্রেটও আছে। কয়েকটি শোকেসে কাচের ওপাশে লেখকের ব্যবহৃত টাই, বেল্ট, টুপি, ক্যামেরা, বই ইত্যাদি সাজানো আছে।

এখন অবধি গোর্কির হাতে লেখা কোনো চিঠিপত্র বা পাণ্ডুলিপি কোথাও দেখলাম না। এই শোকেসে হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির একটি পাতা রাখা। কক্ষের এক কোনায় গোর্কির একটি আবক্ষ ভাস্কর্য রাখা। আমি একটি আর্টিকেলে পড়েছিলাম যে ম্যাক্সিম গোর্কির সব চিঠিপত্র, পাণ্ডুলিপি, ডায়েরি ইত্যাদি নাকি কেজিবির কাছে রাখা আছে। এ বাড়িতে তো কিছুই দেখছি না।

🖱️ অন্য আলোর ফেসবুক পেজ

বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি বাগানে এসে দাঁড়াই। গোর্কি নিজে বাড়ির সামনের বাগানের পরিচর্যা করতেন। বাগান থেকে আমি পথে নেমে আসি। এই পথই ছিল গোর্কির প্রথম জীবনের ঠিকানা। আমি নিজেও রাজপ্রাসাদের চেয়ে পথকেই বেছে নিয়েছি। এই পথ ধরে আমি এখন যাব ম্যাক্সিম গোর্কির সমাধিতে। রেড স্কয়ারের ক্রেমলিন ওয়ালে তিনি এখন বসবাস করেন। এখান থেকে খুব কাছেই। হেঁটেই যাওয়া যায়।

ম্যাক্সিম গোর্কির সমাধি (মাঝেরটি)

আমি রেড স্কয়ারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবি, ১৯৩৬ সালে গত হওয়ার পরও কেন যে ম্যাক্সিম গোর্কির হাতে লেখা লেখাপত্তর এখনো জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়নি, কে জানে!

মস্কোর নান্দনিক পাড়া পেরিয়ে এক কিলোমিটারের একটু বেশি হেঁটে আমি চলে এলাম রেড স্কয়ারে। রেড স্কয়ারে এখন মানুষ জমায়েত হতে শুরু করেছে। আমি আগেও রেড স্কয়ারে এসেছি। তখন লেনিন মসোলিয়াম আর ক্রেমলিন ওয়াল খোলা ছিল না। সপ্তাহে মাত্র তিন দিন খোলা থাকে। ক্রেমলিন ওয়ালে লেনিন মসোলিয়াম দেখে তারপর যেতে হয়। আমি লেনিন মসোলিয়ামের সামনের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এত দিন সব জায়গায় এদেশি ট্যুরিস্ট দেখেছি। এই লাইনে কয়েকজন চায়নিজ ট্যুরিস্টও দেখলাম। আমার পেছনের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে আর সামনের দিকে বেশ দ্রুত এগোচ্ছে। একসময় গেটে চেকিং শেষ হলে লেনিন মসোলিয়ামের দিকে সবাইকে লাইন ধরে যেতে হলো। লেনিন মসোলিয়ামের ভেতরে লেনিনের দেহ মমি করে অবিকৃত অবস্থায় রাখা আছে। কক্ষটি শীতল এবং অন্ধকার। চারপাশে সারিবদ্ধভাবে আর্মি অফিসার দাঁড়িয়ে আছেন। দর্শনার্থী কাউকে কাচের ঘরে শুয়ে থাকা লেনিনকে সামনে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে দেওয়া হয় না। কক্ষে প্রবেশের পর হেঁটে লেনিনের মমি প্রদক্ষিণ করে বেরিয়ে যেতে হয়।

লেনিন মসোলিয়াম থেকে বের হলেই সামনে ক্রেমলিন ওয়াল। এখানে সারিবদ্ধভাবে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আলাদা আলাদা সমাধি পাথরে বাঁধাই করে মাথার কাছে সে ব্যক্তির আবক্ষ ভাস্কর্য বসানো। এর মাঝে স্টালিনের সমাধিও আছে।

কিন্তু এসবে আমার মনোযোগ নেই। আমি হন্যে হয়ে খুঁজছি ম্যাক্সিম গোর্কিকে। কোথায় তিনি? এসব বিশেষ সমাধির একটিতেও তিনি নেই বলে জানালেন একজন রুশ দর্শনার্থী। তিনি আমাকে সামনের লাল ইটের দেয়ালের দিকে দেখতে বললেন। আমি ছুটে চলে গেলাম দেয়ালের কাছে।

ছোটবেলা থেকেই ক্রেমলিন ওয়াল সম্পর্কে শুধু বইয়ে পড়ে এসেছি। সামনে থেকে দেখতে পেয়ে অভিভূত হয়ে গেলাম। এই ক্রেমলিন ওয়ালে সারি সারি কালো নামফলকের মাঝে ম্যাক্সিম গোর্কিও আছেন। মানে নামের নিচে দায়সারাভাবে তাঁর সমাধিও এখানে। দেখে মনে হচ্ছে একটা ছোট চারকোনা ফুলদানির সমান জায়গা বরাদ্দ তাঁর জন্য।

ছোটবেলা থেকেই ক্রেমলিন ওয়াল সম্পর্কে শুধু বইয়ে পড়ে এসেছি। সামনে থেকে দেখতে পেয়ে অভিভূত হয়ে গেলাম। এই ক্রেমলিন ওয়ালে সারি সারি কালো নামফলকের মাঝে ম্যাক্সিম গোর্কিও আছেন। মানে নামের নিচে দায়সারাভাবে তাঁর সমাধিও এখানে। দেখে মনে হচ্ছে একটা ছোট চারকোনা ফুলদানির সমান জায়গা বরাদ্দ তাঁর জন্য, যেখানে গোলাপি প্লাস্টিকের ফুল রাখা আছে।

ক্রেমলিন ওয়ালে সারি সারি সমাধির মাঝে ম্যাক্সিম গোর্কির সমাধি

আর সমাধি হিসেবে আলাদা করে কিছু নেই, শুধু সেই ফুলদানি ছাড়া। সমাধির জায়গাটা সমানভাবে পাকা করা। দেখে মনে হচ্ছে ফুটপাত। আমার খুব অভিমান হলো। এত অবহেলায় তাঁকে রাখা হয়েছে! কিন্তু এই সারি সারি নামফলকের মাঝে কোনটি ম্যাক্সিম গোর্কির কীভাবে বুঝব? সবই তো রাশিয়ান ভাষায় লেখা।

আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। আমি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কর্তব্যরত আর্মি অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি আঙুল তুলে এক কোনার একটি নামফলক দেখিয়ে দিলেন, যেখানে যাওয়া যাবে না। সেই বিশেষ সমাধির সামনে ব্যারিকেড দেওয়া। তিনি কি ভয়ংকর কেউ যে ব্যারিকেড দিয়ে রাখতে হবে! উননব্বই বছর আগে গত হয়ে যাওয়া এক ব্যক্তিকে এত ভয় কেন?

পাশাপাশি এতগুলো সমাধি দেখে মন বিষণ্ন হয়ে গেল। এই সামান্য জায়গায় এতগুলো বিখ্যাত মানুষকে গাদাগাদি করে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ক্রেমলিন ওয়ালের সব নামফলক একই, সবাই এখানে সমান। ম্যাক্সিম গোর্কি জীবনে খ্যাতি পেয়েছিলেন বিস্তর, তবে জীবনাবসানের পর তাঁকে আগের সাধারণ জীবনে ফিরে যেতে হবে, তা কি তিনি জানতেন?

আমরাই কি জানি আমরা কোথায় যাব!