
‘সুলতান অব সুইং’ খ্যাত ওয়াসিম আকরাম ১৯৮৪ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রেখে খেলে গেছেন পরবর্তী দুই দশক। ১৯৯২ সালে বিশ্বকাপ জেতা আকরাম ওয়ানডে ও টেস্ট মিলিয়ে ৯০০–এরও বেশি উইকেটের মালিক। ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলারদের একজন আকরামের আত্মজীবনী ‘সুলতান: আ মেমোয়র’ প্রকাশিত হয় ২০২২ সালে। যেখানে নিজের খেলোয়াড়ি জীবন, নেশায় আসক্তি, পারিবারিক সম্পর্ক, পাকিস্তান ক্রিকেটে ফিক্সিং নিয়ে অকপটে অনেক কথা লিখেছেন আকরাম। আত্মজীবনীতে ‘ডার্টি মানি’ নামে একটা অধ্যায়ে আকরাম লিখেছেন পাকিস্তান ক্রিকেটের ম্যাচ ফিক্সিং নিয়েও।
আকরামের লেখা ‘ডার্টি মানি’ অধ্যায়টির আগের পর্ব পড়ুন এখানে
জোহানেসবার্গে পৌঁছালাম ম্যান্ডেলা ট্রফির সেরা-তিন ফাইনাল সিরিজের ঠিক আগে। অস্ত্রোপচারের পর আমি তখনো পুরোপুরি ফিট হইনি। কিন্তু তার চেয়েও বড় চিন্তার বিষয় ছিল, দলটা যেন আবার সেই পুরোনো অবস্থায় ফিরে গেছে। মনে হচ্ছিল, আমি এই দলে একেবারেই বাইরের একজন। একটা সুখী দলের যে বৈশিষ্ট্য, তার কিছুই ছিল না। কোনো আড্ডা নেই, হাসাহাসি নেই। সবাই যেন কারও না কারও ভয়ে আছে, কেউ ঘরে ঢুকলেই কথা থেমে যাচ্ছে।
আমিও শেষমেশ নিঃশব্দে এটাই মেনে নিলাম। হুমা (আকরামের স্ত্রী) তখন পাশে ছিল না, ফলে কারও সঙ্গে মন খুলে কথা বলার সুযোগও ছিল না। ভাবলাম, ঠিক আছে, নিজের মতো থাকব, একা ঘুরে বেড়াব, সময়টাকে উপভোগ করার চেষ্টা করব। তখনকার দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল পার্টির দেশ, রাতজাগা রঙিন জীবনের ঠিকানা। কিন্তু কিছু ঘটনা ছিল, যেগুলো উপেক্ষা করা যাচ্ছিল না।
আগের গ্রীষ্মের অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা জানতাম, দক্ষিণ আফ্রিকায় ওয়ানডেতে স্কোরবোর্ডে রান তুলে রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। হ্যান্সি ক্রনিয়েদের দল প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে ভালোবাসত। তারা অসাধারণ ডিফেন্সিভ দল—বল হাতে আঁটসাঁট, ফিল্ডিংয়ে ক্ষিপ্র। তবে লক্ষ্য তাড়া করার মতো ব্যাটিং শক্তি তাদের ছিল না। তার ওপর ওদের মাঝারি মানের ফ্লাডলাইটে বলও বেশ সুইং করত। কিন্তু ওয়ান্ডারার্সে টস জিতে আমরা ব্যাটিং না করে তাড়া করার সিদ্ধান্ত নিলাম—আর সেই সিদ্ধান্ত ছিল একেবারে ভয়ানক। ইজাজ (আহমেদ) আর বাসিত (আলী) ক্যাচ দিয়ে আউট; সেলিম (মালিক), রশিদ লতিফ, আমির সোহেল রানআউট—২২ রানে ৬ উইকেট পড়ে গেল!
দ্বিতীয় ফাইনালের আগে নিউল্যান্ডসে দল যখন একত্র হলো, তখন সবাই একে অন্যকে দোষ দিচ্ছিল। ইনতিখাব (পাকিস্তান দলের ম্যানেজার) প্রস্তাব দিলেন, সবাই যেন একটা পবিত্র তাবিজ ছুঁয়ে সততার শপথ নেয়। কিন্তু সেলিম কীভাবে যেন সেই আনুষ্ঠানিকতায় থাকতে পারলেন না, এলেন টসে জেতার পর। এবার ব্যাটিং করার যুক্তি ছিল আরও শক্তিশালী—বৃষ্টি হতে পারে আর বিশ্বকাপের পর দক্ষিণ আফ্রিকা যে বৃষ্টি-ফর্মুলা চালু করেছিল, তা ছিল প্রথম ইনিংসে ব্যাট করা দলের পক্ষে একতরফা। টস হারার পর ক্রনিয়ের তাই মাথায় হাত দেওয়ার অবস্থা, কিন্তু তারপর সে রীতিমতো চমকে গেল, যখন সেলিম বলল—আমরা আগে ফিল্ডিং করব।
ড্রেসিংরুমে সবাই অবিশ্বাসে মাথা নাড়ছিল। শুধু তা-ই নয়, সেলিম তাঁর বন্ধু আকরাম রাজাকে খেলালেন কবির খানের জায়গায়—এমন এক পিচে, যেখানে বাউন্স আর ক্যারি ছিল, সেখানে বাঁহাতি পেস বোলারের বদলে একজন অফ-স্পিনার! ২৬৬ রান তাড়া করতে গিয়ে আমাদের স্কোর দাঁড়াল ৬ উইকেটে ৪২। ওই পিচে, যেখানে আমরা পরে বোলিং করলে ম্যাচ জিততে পারতাম, সেখানে রান তাড়া করে ম্যাচ হারলাম ১৫৭ রানে!
সেলিম ছিলেন রহস্যময়। তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করলে শুধু কাঁধ ঝাঁকাতেন আর বলতেন, ‘সব ঠিক আছে, কোনো সমস্যা নেই।’ আর তাঁর ডেপুটি রশিদ লতিফ চিরকাল অভিমানে ডুবে থাকা মানুষ—যেটা অনেক সময় আরও খারাপ লাগত। ১৯৯৫ সালের ১৪ জানুয়ারি, ফ্রন্টিয়ার নিউজে উসমান সিরাজী নামের করাচির এক সাংবাদিকের একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হলো, যার সঙ্গে রশিদের এতটাই ঘনিষ্ঠতা ছিল যে তারা একই রুমে থাকত। সেই রিপোর্টের শিরোনাম—‘সহ-অধিনায়ক হতাশায় দেশে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন’। রিপোর্টে বলা হয়, রশিদ দলে বিভাজনের কারণে মন খারাপ করে সফর বাদ দিয়ে দেশে চলে যেতে চাইছেন। অথচ এই বিভেদের জন্য সে নিজেও কম দায়ী ছিল না এবং সেটি সারাতে সে কিছুই করেনি।
পরের টিম মিটিংয়ে কেউ একজন হঠাৎ বলে উঠল, ‘এই টস আর বাজি নিয়ে হচ্ছেটা কী?’ আমিও গলা চড়িয়ে বললাম, ‘বন্ধুরা, কী হচ্ছে এসব? আমরা কি শুধু ক্রিকেটটা উপভোগ করতে পারি না? একজন আরেকজনের প্রতি আরও আন্তরিক হতে পারি না?’ কথা-পাল্টা কথায় যখন পুরো রুম উত্তপ্ত, আমি উঠে বেরিয়ে গেলাম। বিরক্ত, ক্লান্ত, অতিষ্ঠ। ভাবলাম, আমি কী এমন করেছিলাম যে এ রকম সতীর্থ পেলাম! আমাকে কোণঠাসা করার পর এখন ওরা একে অন্যকে টেনে নামাতে ব্যস্ত।
ওয়ান্ডারার্সে টেস্ট ম্যাচ শুরুর কয়েক দিন আগে ওয়াকার ও রশিদ দুজনই নিজেদের ‘আনফিট’ ঘোষণা করল। ওয়াকার ফিরে গেল পিঠের চোট নিয়ে, রশিদ জানাল, ওর পিঠে ব্যথা। মঈন এল দলে। কিন্তু কবির বা আতা, দুই রিজার্ভ পেসারের কাউকে নেওয়া হলো না। বরং ডাক পড়ল আমির নাজিরের। ১৪ ঘণ্টার বিমানভ্রমণ শেষে পাকিস্তান থেকে লন্ডন ঘুরে আসা একটা ছেলে মাঠে পৌঁছাল ম্যাচ শুরুর ৩৫ মিনিট পর। দুর্ভাগ্য আমিরের—প্রতিভা ছিল, কিন্তু ৭ ওভার পরই তার পেশিতে টান পড়ে গেল। আমাদের বোলিং আক্রমণ হয়ে গেল তিনজনের। আর ব্যাটসম্যানরা দুই ইনিংসেই আত্মসমর্পণ করলেন। আমরা হারলাম ৩২৪ রানে। পাকিস্তানের যেকোনো অধিনায়কের পক্ষে এমন হার সামলানো কঠিন। সেলিমের জন্যও এটি ছিল বড় ধাক্কা। কিন্তু রশিদ লতিফের জন্য যেন বড় স্বস্তি, কারণ সে আগেভাগেই নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিল। আর আমির সোহেল? ও তো সব সময়ই শুধু সুযোগ খুঁজত ওপরে যাওয়ার।
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজের প্রথম টেস্টের জন্য যখন হারারেতে পৌঁছালাম, আমরা যেন একে অন্যের চোখের দিকেও তাকাতে পারছিলাম না। যদিও জিম্বাবুয়ে তখনো কোনো টেস্ট জেতেনি, দলটা ছিল দারুণ—ফ্লাওয়ার ব্রাদার্স, স্ট্র্যাংস, ডেভিড হুটন, হিথ স্ট্রিক। মনে আছে, আমি টানা ৭ ওভার মেডেন দিয়েছিলাম অ্যান্ডি আর গ্রান্ট ফ্লাওয়ারকে। ওরা শুধু লেন্থে বল ছেড়ে দিচ্ছিল, আমাকে ক্লান্ত করে তুলছিল। শেষ পর্যন্ত ২৬৯ রানের জুটি গড়ল। শুনেছি, বোম্বের জুয়াড়িরা এই টেস্টের সব বাজি বাতিল করে দিয়েছিল, নিশ্চিত ছিল ম্যাচে দুর্নীতি হয়েছে। তবে আমার বিশ্বাস, আমাদের হারের পেছনে কোনো দুর্নীতি ছিল না, আমরা হেরেছিলাম ব্যাট হাতে মনোযোগহীনতা, মানসিকভাবে ভঙ্গুর অবস্থা আর প্রতিপক্ষের দুর্দান্ত ফিল্ডিংয়ের কারণে।
বুলাওয়েতে আমি কিছুটা খ্যাপা হয়ে গেলাম—৮৩ রানে ৮ উইকেট নিলাম, হুটনের আঙুল ভেঙে দিলাম, আম্পায়ারের কাছ থেকে ক্যাপ টেনে নেওয়ার জন্য তিরস্কৃত হলাম।
কিন্তু সবচেয়ে বড় ঝামেলা বাধল তৃতীয় টেস্টের প্রথম দিন, ১৫ ফেব্রুয়ারি। অস্ট্রেলিয়া থেকে খবর এল—শেন ওয়ার্ন আর টিম মে অভিযোগ করেছেন, গত বছর পাকিস্তান সফরে সেলিম ওদের টাকা অফার করেছিলেন খারাপ খেলতে! এরপর মার্ক ওয়াহর অভিযোগও সামনে আসে, রাওয়ালপিন্ডির এক ওয়ানডে নিয়ে। সত্যি বলতে কি, আমি কাকে বিশ্বাস করব বুঝতে পারছিলাম না। ব্যাটসম্যান হিসেবে সেলিমকে আমি শ্রদ্ধা করতাম, কিন্তু মানুষ হিসেবে কখনোই পছন্দ করিনি। আর অস্ট্রেলিয়ানরা কেন বানিয়ে বানিয়ে এমন অভিযোগ করবে?
সেলিম পুরোপুরি বিচলিত হয়ে পড়লেন। তিনি সব অস্বীকার করলেন—‘আমি কারও সঙ্গে মিশি না। আমি চুপচাপ মানুষ।’ কিন্তু তত দিনে আর এসব উপেক্ষা করার সুযোগ ছিল না। আগে আমরা একে অন্যের দিকে আঙুল তুললাম, এখন বাইরের লোকজন তোলা শুরু করেছে। দল যেন ভেঙে টুকরা টুকরা। এক সকালে আমরা সবাই ভিক্টোরিয়া ফলস ঘুরতে যাচ্ছি, দেখা গেল রশিদ নেই, বাসিতও না। পরে জানলাম, রশিদ ‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর মজা পাচ্ছেন না’ বলে অবসর ঘোষণা করেছে, আর বাসিতকে নিয়েই দেশে ফিরেছে। ওদিকে আমির সোহেল বলে দিল, ‘আমি বর্তমান জাতীয় দলে এমন অনেক খেলোয়াড়ের নাম বলতে পারি, যারা ঘুষ নিয়ে ম্যাচ হেরেছে।’
পিসিবি তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নিল। বোর্ড প্রতিনিধি সেলিম আলতাফ লাহোর থেকে উড়ে এসে সবাইকে বলে দিলেন—কোনো কথা বলা যাবে না। সেলিম আর ইনতিখাব বরখাস্ত হলেন—দুর্নীতির জন্য নয়, বাজে ফলাফলের জন্য। সেলিমের বন্ধু আকরাম রাজা আর তার ভগ্নিপতি ইজাজও বাদ পড়ল। রশিদ আর বাসিত সাময়িকভাবে ‘অবসর’ নেওয়ায় পেপসি এশিয়া কাপের জন্য আমাদের নতুন নেতৃত্বে এল মঈন খান ও সাঈদ আনোয়ার, আর অভিজ্ঞ খালিদ ইবাদুল্লাহ হলেন টিম ম্যানেজার।
আমি তখন পুরোপুরি বিরক্ত। হুমাকে ম্যানচেস্টার থেকে আমার সঙ্গে যোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। সে যখন আকাশে, শুনলাম—পিসিবি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শারজা সফরে খেলোয়াড়দের স্ত্রীরা থাকতে পারবে না। নতুন চেয়ারম্যান জুলফিকার বুখারির সঙ্গে দেখা করলাম। বললাম, আমি এত কিছু সহ্য করেছি, এবার আর না—নিয়ম না বদলালে খেলব না। জুলফিকার ভালো মানুষ ছিলেন, আইচিসন-শিক্ষিত কূটনীতিক, প্রেসিডেন্ট লেঘারির পছন্দের লোক—বোর্ডের জটিলতা বাড়াতে চাইলেন না। কৌশলে হুমাকে থাকার অনুমতি দিলেন।
আমরা ভারত ও বাংলাদেশকে হারালাম। কিন্তু মঈন চিকেন পক্সে ছিটকে যাওয়ার পর শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে গেলাম। ছয় বছরে প্রথমবারের মতো কোনো গালফ ফাইনালে উঠতে পারলাম না। ভারত কাপ নিয়ে গেল।
আমার ক্যারিয়ারে অনেক কঠিন সফর গেছে, কিন্তু ওই সফর থেকে ফেরার সময় যতটা স্বস্তি পেয়েছিলাম, তার তুলনা নেই।
ল্যাঙ্কাশায়ারে যোগ দেওয়াটা আমার জন্য ছিল যেন ছুটি কাটাতে যাওয়ার মতো। পরে দেখা গেল, সেটাই হলো ক্লাবের হয়ে আমার সেরা মৌসুম। কারণটা সম্ভবত খুব সাধারণ—আমি এমন কিছু ক্রিকেটারের সঙ্গে খেলছিলাম, যাদের আমি পছন্দ করতাম, বিশ্বাস করতাম। আর ছিল কিছু অনুগত সমর্থক, যারা যা–ই হোক, সব সময় দলের পাশে থেকেছে। আজ ওল্ড ট্র্যাফোর্ড, পরদিন হোভ, তার পরের সপ্তাহে এজবাস্টন—তারা সব সময়ই হাজির, হাসিখুশি, ধৈর্যশীল।
হুমা আর আমি তখন আল্ট্রিনচামে বেশ আরামেই ছিলাম। থাকতাম বিমানবন্দর থেকে ১০ মিনিট, সেন্ট্রাল ম্যানচেস্টার থেকে ১৫ মিনিট আর ওল্ড ট্র্যাফোর্ড থেকে ২০ মিনিটের দূরত্বে। মাঝেমধ্যে ঘুরতে যেতাম ডানহাম ম্যাসি—ন্যাশনাল ট্রাস্টের একটা চমৎকার প্রাসাদ, যার চত্বরে হরিণ ঘুরে বেড়াত।
এমন একটা জায়গায় থাকলে পাকিস্তানি ক্রিকেট প্রায় ভুলে যাওয়াই যায়। মনে হচ্ছিল, তখন সবাই আইসিসি কী করে, সেটা দেখার অপেক্ষাতেই আছে বুঝি। কিন্তু তারা বরাবরের মতোই অকার্যকর, কিছুই করল না। বরং শোনা গেল সেলিম উল্টো হুমকি দিচ্ছে, নিষেধাজ্ঞা না তুললে আইনি ব্যবস্থা নেবে।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম টেস্টের ঠিক আগের দিন আমি পেশোয়ারে পৌঁছালাম। গিয়ে শুনি, আমাদের নতুন অধিনায়ক রমিজ রাজা, নতুন ম্যানেজার মুশতাক মোহাম্মদ। তবে মানসিকতা পুরোনোই। ল্যাঙ্কাশায়ারে আমি সব সময় আলাদা হোটেলরুম পেতাম, কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি, আমাকে রুম শেয়ার করতে হবে। ৬০ টেস্ট আর প্রায় ২০০ ওয়ানডে খেলার পরও আমার সুযোগ–সুবিধা সেই একজন নতুন খেলোয়াড়ের মতো!
মাজিদ খানের এই কিপটে আচরণের কথা তাঁকেই সোজাসাপটা বললাম। শেষ পর্যন্ত যা চেয়েছিলাম, তা-ই পেলাম। এরপর মাঠে আমার কাজও ঠিকভাবে করলাম—৭৯ রানে ৭ উইকেট নিয়ে হলাম ম্যাচসেরা, আর মঈনের সঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ জুটিতে করলাম ৩৬ রান।
কিন্তু ফয়সালাবাদে কাঁধে চোট পেলাম, ওয়াকার তখনো পিঠের চোটে ভুগছে। শিয়ালকোটে মঈনের দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরির পরও তাই শেষ পর্যন্ত আমরা ১৫ বছর পর ঘরের মাঠে প্রথম সিরিজ হারলাম। আমার অনুপস্থিতিতে পরে আমরা শ্রীলঙ্কার কাছে ওয়ানডে সিরিজও হেরে গেলাম। তারপর শারজাতে পেপসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনালে উঠতেও ব্যর্থ হলাম।
আমির সোহেল শেষ দুটি ম্যাচ খেলেনি, বলেছিল চোট, কিন্তু আসলে সে রমিজের নেতৃত্ব নিয়ে হতাশ ছিল। এদিকে সেলিমের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের চাপ বেড়েই চলছিল। পিসিবি চেয়ারম্যান আরিফ আলী আব্বাসি অবশেষে তদন্ত কমিশন ঘোষণা করলেন। প্রধান হলেন ফখরুদ্দিন ইব্রাহিম—সাবেক সুপ্রিম কোর্ট জজ, আইনমন্ত্রী ও সিন্ধুর গভর্নর। কিন্তু ব্যাপারটা বেশি দূর গেল না। সেলিম সব অভিযোগ অস্বীকার করল।
অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড জানিয়ে দিল, তারা শেন ওয়ার্ন, মার্ক ওয়াহ আর টিম মেকে সাক্ষ্য দিতে পাকিস্তানে পাঠাবে না। তখনো আমরা জানতাম না, আসলে ওয়ার্ন আর ওয়াহ নিজেরাও জড়িয়ে ছিল বুকি জনের সঙ্গে, আর গোপনে তারা শাস্তি হিসেবে জরিমানাও দিয়েছিল। আব্বাসি বললেন, ‘পাহাড় যদি মুসার কাছে না আসে, তাহলে...।’ বুঝলাম, ওখানেই সব থেমে যাবে।
১৯৯৫ সালের ২১ অক্টোবর, ইব্রাহিম কমিশনের ৯ পাতার রিপোর্ট প্রকাশিত হলো। সেখানে বলা হয়—অস্ট্রেলিয়ানদের সহযোগিতা না পাওয়ায় তিনি কিছুই প্রমাণ করতে পারেননি। একই সঙ্গে তিনি এটাও মনে করেন, সেলিম মালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো ‘বিশ্বাসযোগ্য নয় এবং ভিত্তিহীন।’
পিসিবি এই অরাজকতার মধ্যে পুরো বিষয়টা আরও গোলমেলে করে তুলল—রমিজ, মুশতাক তো বাদ পড়লই, ট্যুর ম্যানেজার মাজিদকেও বাদ দেওয়া হলো। খেলোয়াড়েরা তখনো ট্রেনিং ক্যাম্পে, ছয় সপ্তাহের অস্ট্রেলিয়া সফরের ঠিক আগে।
সাঈদ আনোয়ার টাইফয়েডে আক্রান্ত, ওয়াকার তখনো চোটে কাবু। প্রশ্ন উঠল—এই ভাঙাচোরা দলকে কে নেতৃত্ব দেবে?
আমি দেব।
ওয়াসিম আকরাম দ্বিতীয় দফায় অধিনায়কত্ব পান ১৯৯৫ সালের নভেম্বরে অস্ট্রেলিয়া সফরের আগে। ২০০০ সাল পর্যন্ত অধিনায়কত্ব করেছেন তিনি। এই সময়ে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সঙ্গে তাঁর নামও জড়িয়েছে। পিসিবি গঠিত বিচারপতি কাইয়ুম কমিশন ২০০০ সালে যে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়, সেখানে সেলিম মালিক ও আতাউর রেহমানকে আজীবনের জন্য ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধের সুপারিশ করা হয়। অন্য অনেকের সঙ্গে জরিমানা করা হয় ওয়াসিম আকরামকেও। তাঁকে আর কখনো অধিনায়ক না করার সুপারিশও করা হয়। ২০০৩ বিশ্বকাপের পর আকরাম দল থেকে বাদ পড়েন এবং অবসর নেন।