বাংলাদেশের নারী চিকিৎসকদের মধ্যে প্রথম জাতীয় অধ্যাপক ডা. শাহলা খাতুন
বাংলাদেশের নারী চিকিৎসকদের মধ্যে প্রথম জাতীয় অধ্যাপক ডা. শাহলা খাতুন

সাক্ষাৎকার: জাতীয় অধ্যাপক শাহলা খাতুন

জুনিয়র চিকিৎসকদের বলি, ধৈর্য ধরো, হোমওয়ার্ক করো, ডাক্তারি ম্যাগাজিন পড়ো

বাংলাদেশের অন্যতম প্রাজ্ঞজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসক জাতীয় অধ্যাপক শাহলা খাতুন। অধ্যাপনার পাশাপাশি বহু মানুষের চিকিৎসা করেছেন, বহু মানুষকে আলোকিত করেছেন এবং দেশের স্বাস্থ্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলোর এবারের আয়োজনে অতিথি ছিলেন তিনি। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক আনিসুল হক। দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারে নিজের জন্ম, শৈশব, পড়াশোনাসহ জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন শাহলা খাতুন।

প্রশ্ন

প্রথম আলোর বিশেষ আয়োজন ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলোয় আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। আজ আমরা এসেছি আমাদের জাতীয় অধ্যাপক, আমাদের একজন অভিভাবক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসক শাহলা খাতুনের কাছে। শাহলা আপা, আপনাকে আমাদের প্রথম আলোর এই বিশেষ—আমরা যে ভিডিও সাক্ষাৎকার নিই—এই অনুষ্ঠানে স্বাগত জানাই।

জাতীয় অধ্যাপক ডা. শাহলা খাতুন: ধন্যবাদ এবং খুশি হলাম। তবে জানি না কতটুকু বিখ্যাত। তবে দীর্ঘ অনেক বছর ধরে কাজ করছি মানুষের সেবায়।

প্রশ্ন

সবাই আমরা এই অনুষ্ঠানে আমাদের প্রাজ্ঞজনদের কথা শুনি, জীবনের কথা শুনি। একদম জন্ম থেকেই শুরু হয়। আপনার জন্ম ১৯৩৯ সালে। সেই হিসাবে আপনার ৮৫-৮৬ বছর বয়স হচ্ছে।

শাহলা খাতুন: ৮৬।

প্রশ্ন

জীবনের অভিজ্ঞতা ভালোই হয়েছে। আপনার ওই শৈশবের কথা মনে পড়ে যে আপনার সিলেটে তো জন্ম হলো। আপনার আব্বা...

শাহলা খাতুন: বয়স হলেও ব্রেনটা সারাক্ষণ কাজে থাকে। সে জন্য বোধ হয় ডিমেনশিয়া হয়নি। ছোটবেলা থেকে মনে আছে প্রায় সবকিছুই।

প্রশ্ন

আপনার আব্বার কথা যদি একটু বলতেন।

শাহলা খাতুন: আমার আব্বা বেসিক্যালি ছিলেন একজন অ্যাডভোকেট, আইনজ্ঞ। কিন্তু ওনারা তো বহু আগের মানুষ। সবাই গিয়ে পড়াশোনা করত কলকাতায়।

প্রশ্ন

ওনার নাম হচ্ছে আবু আহাম্মদ আবদুল হাফিজ।

শাহলা খাতুন: হ্যাঁ। কলকাতায় পড়াশোনা করতেন ওনারা। আব্বা যখন কলকাতায়—এটা অবশ্য আমার শোনা কথা—পড়তেন, তখন খেলাফত আন্দোলন শুরু হয়। খেলাফত আন্দোলন শুরু হওয়ায় আমার আব্বার আব্বা, মানে আমার দাদা ছিলেন আবার ম্যাজিস্ট্রেট। ওনারা বহুকাল আগের। আমার দাদা ১৯৩৩ সালে নিজেই প্রিম্যাচিউর অবসরে চলে গিয়েছিলেন। তো উনি দরবারে কী জানি একটা খেতাব পেয়েছিলেন, তারপর খান বাহাদুর হন। উনি যখন ছিলেন আসামে গুয়াহাটি বা কোথাও। দাদা যখন শুনেছেন যে ছেলে পড়াশোনা করছে না, খেলাফত আন্দোলনে জড়িয়েছে—উনি ওই আগের দিনের টেলিগ্রাম করলেন, শার্প, আসো। আব্বা সোজা চলে গেছেন। তারপর ওখান থেকে কোনো কথা না বলে পাঠিয়েছেন।

প্রশ্ন

আপনার আব্বা তো মুসলিম লীগ গঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

শাহলা খাতুন: আব্বা খেলাফত আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। তারপর ওখান থেকে রাজশাহী গিয়ে পরীক্ষা দিলেন, দিয়ে আবার কলকাতা ফিরে গিয়ে ল এবং এমএ পাস করলেন। এমএ বোধ হয় আরবিতে করেন। তারপরে উনি সিলেট থেকে কিছুদিন কী করেছিলেন, ওটা আমরা জানি না। এরপর স্কুলের টিচার ছিলেন।

প্রশ্ন

আপনার শৈশবের কথাই বরং আমরা শুনি। আপনার আম্মাও তো খুবই বিখ্যাত দেখা যাচ্ছে। ওনার নাম হচ্ছে সৈয়দ শাহার বানু চৌধুরী।

শাহলা খাতুন: ওনার দাদা ছিলেন মরমি কবি, সৈয়দ আশার আলী। তো আমার নানাবাড়ি হলো সৈয়দপুর, সিলেট। বহু গেছি ছোটবেলায়। তখন কষ্ট হতো যেতে। নৌকা করে যেতে হতো। শীতের দিনে ঘোড়ায় করে নানা নিয়ে যেত। গেছি, আমার মনে আছে।

প্রশ্ন

আপনার আম্মা—উনি তো ভাষা আন্দোলনে...

শাহলা খাতুন: আমার মায়েরা ভাষা আন্দোলনে অনেক কিছু করেছেন। ও কিসের বইয়ে... উনি মারা গেলেন ভেরি রিসেন্টলি? ওই যে ভাষা আন্দোলনের বই লিখছেন যে…

প্রশ্ন

বদরুদ্দীন উমর?

শাহলা খাতুন: হ্যাঁ, ওনার বইয়ে আম্মাদের নাম আছে, ভাষা আন্দোলনের জন্য। তখন থেকে আমার আব্বা-আম্মা প্র্যাক্টিক্যালি পলিটিকস ছেড়ে দিলেন। আর তারপর শুধু করতেন সমাজসেবা। আর এডুকেশন। সিলেটে এমন কোনো স্কুল-কলেজ নেই, যেখানে দেখি নাই আমার পিতা অনুপস্থিত আছেন, আর আমার মা। যদিও আমার মা খুব বেশি শিক্ষিত ছিলেন না। জমিদারবাড়ির মেয়ে, নিজের বাড়ির স্কুলে পড়েছেন ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত। তবে স্বশিক্ষিত। বহু সমাজসেবার কাজ করে গিয়েছেন। যখন মারা যান, তখনো তিনি অনেক স্কুলের গভর্নিং বডিতে ছিলেন।

প্রশ্ন

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কথা কি আপনার মনে আছে?

শাহলা খাতুন: হ্যাঁ, কিছু তো মনে থাকবেই। ক্লাস সেভেন না এইটে পড়ি।

প্রশ্ন

কিছু কিছু মনে আছে?

শাহলা খাতুন: আছে। আমাদের এখানে মুহিত ভাই (প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত) অ্যারেস্ট হলো। অ্যারেস্ট হয়ে কিছুদিন ছিল।

প্রশ্ন

আবুল মাল আবদুল মুহিত আপনার ভাই। উনি ভাষা আন্দোলনে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

শাহলা খাতুন: ওখানে সিলেটে গিয়ে অ্যারেস্ট হয়েছিলেন। তো ওখানে বেশিক্ষণ থাকতে হয়নি। আব্বা যাওয়ায় ছেড়ে দিয়েছিল। তবে ঢাকায় ছিলেন বহুদিন সেন্ট্রাল জেলে। সত্যি কথা বলতে কি উনি সেন্ট্রাল জেলে যখন ছিলেন, তখনই উনি ডিসাইডেড যে উনি সিভিল সার্ভিসে যাবেন। দেখলেন যে অনেক কাজ করা যায়।

প্রশ্ন

হুম। তারপর আপনার স্কুল কোনটা কোনটা ছিল?

শাহলা খাতুন: আমাদের সময় সিলেটে বলত, বালিকা বিদ্যালয়—সরকারি উচ্চবালিকা বিদ্যালয়। সেটাকে এখন পাইলট স্কুল বোধ হয় বলে। [অগ্রগামী স্কুল]

প্রশ্ন

সেখান থেকে আপনি…

শাহলা খাতুন: সেখান থেকে আমি ম্যাট্রিক পড়ছি, ক্লাস থ্রি টু ম্যাট্রিক। তারপরে আমাদের সিলেটের কলেজে বহু লোকও পড়েছেন—এমসি কলেজ।

প্রশ্ন

জি।

শাহলা খাতুন: ওখানে ইন্টারমিডিয়েট। তারপরে...

ডা. শাহলা খাতুন নিজের ফেলে আসা দিনগুলির গল্প শোনালেন
প্রশ্ন

১৯৫৪ সালে আপনি ম্যাট্রিক পাস করলেন। ১৯৫৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট করলেন।

শাহলা খাতুন: এখন ইন্টারমিডিয়েট কেউ কেউ বোঝে না। তারপরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ। তো আমার আম্মা-আব্বা সারাক্ষণই আসতেন ঢাকায়। আমাকেও দেখতে আসতেন, আমিও যেতাম। আমাদের সময় ছুটিটুটি কম ছিল, আমরা যেতে পারতাম না।

প্রশ্ন

আপনারা তো ১৩ ভাইবোন।

শাহলা খাতুন: হ্যাঁ।

প্রশ্ন

১৩ ভাইবোন সিলেটের ওই বাড়িতে। ওসব মনে পড়ে না? সব ভাইবোন একসঙ্গে?

শাহলা খাতুন: ওইটাই তো। সারাক্ষণই যত রকমের দুনিয়াতে খেলা আছে, আমাদের বাড়িতে হতো। ওই তখনকার দিনে আমার মা ব্যাডমিন্টন-ট্যাডমিন্টন খেলতেন। আর আমরা কত যে খেলা খেলছি, জানি না। তা ছাড়া আমাদের বাড়ির সাথেই...

প্রশ্ন

স্কুলে থাকতে তো আপনি সাইকেল চালাতে পারতেন।

শাহলা খাতুন: ওটা তো স্কুলে শিখছি। ক্লাস ফাইভে থাকতে বোধ হয়।

প্রশ্ন

সাইকেল চালাতেন?

শাহলা খাতুন: আমাদের একজন ক্যালকেসিয়ান বয় ছিল, সে কাজ করত। সে সাইকেল চালানো শিখিয়ে দিয়েছিল। তো সাইকেল চালিয়েছি, গাড়ি চালিয়েছি। গাড়ি সিলেটে স্কুল লাইফে চালাইনি। চালিয়েছি আমি লন্ডনে গিয়ে। লন্ডনে গিয়ে ঠিক করলাম যে ড্রাইভিং শিখব।

প্রশ্ন

তারপর স্কুল-কলেজে তো আপনি কালচারাল অ্যাকটিভিটিস করতেন।

শাহলা খাতুন: আমাদের সব রকম যা হতো, আমরা—আমি অবশ্য কোনো দিন গানটান গাইনি।

প্রশ্ন

কিন্তু আবৃত্তি করতেন।

শাহলা খাতুন: সেটা করতে পারতাম, মনে হয়। আমাদের স্কুলটা আবার খুব ভালো স্কুল ছিল। কনক পুরকায়স্থ ফার্স্ট হয়েছিল কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে। ওনার নামে স্কুলে একটা পুকুরও ছিল এবং খুব নাম ছিল স্কুলটির। বেশির ভাগ টিচাররা বাইরে থেকেই আসতেন তখন। কারণ, সিলেটে ও রকম খুব বেশি ছিল না। তারপর পাকিস্তান হওয়ার পরে আমার মনে আছে, স্কুলে আমাদের কিছুদিন পরে পরে… সিলেটে তো খুব একটু বেশি দাঙ্গা হতো—হিন্দু-মুসলিম, এটা আমরাও দেখেছি। আমার আব্বার এগুলো বন্ধ করাই কাজ ছিল। আর আমার বড় দুই ভাই—মুহিত ভাই আর মুহশি ভাই—দুজনকে পাঠিয়ে দিতেন একেক পাড়ায় পাহারা দেওয়ার জন্য। আর সবচেয়ে বেশি ভয় ছিল যে…সুরমা নদী দেখছেন?

প্রশ্ন

হুম, দেখেছি।

শাহলা খাতুন: সুরমা নদীর ব্রিজ, ওটা। এখন তো অনেক ব্রিজ আছে। (ভয় ছিল যে সুরমা নদীর) ওই পাশ থেকে যেন কেউ না আসতে পারে এই পাশে। এলে ভেঙে ফেলবে সব। তো ওনারা সবাই গিয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতেন। তখনকার দিনে শুনেছি যে আব্বারা ফটো তুলেছেন। তুলে পাঠিয়েছেন দেখাতে—না, কিছু ভাঙেনি। ওরা মনে করছে যে সিলেটে বোধ হয় দরগা-টরগা ভেঙে ফেলছে। তো ওনারা নাকি এটা নিয়ে তাদের দেখিয়েছেন—না তো, সেগুলো কিছুটা গল্প। যাই হোক, আর স্কুলে থেকে মনেই আছে প্র্যাক্টিক্যালি সবকিছু।

নিজ বাসায় ডা. শাহলা খাতুন। তাঁর জন্ম ১৯৩৯ সালের ২৯ জুন সিলেটে
প্রশ্ন

‘৫৬ সালে আপনি ঢাকা মেডিকেলে…

শাহলা খাতুন: তারপরে আমি ’৬১-তে পাস করে চাকরিতে…আমি লাকি, কারণ তখন আমাদের গভর্নমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান গভর্নমেন্ট চাকরিতে নিয়ে নিয়েছিল।

প্রশ্ন

আপনি ১৯৫৬ সালে যে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ঢুকলেন, ’৬১-তে পাস করলেন। সে জন্য আপনাদের একটা ‘১৯৫৬ ক্লাব’ আছে। সেই বন্ধুবান্ধব এখনো অনেকে বেঁচে আছে।

শাহলা খাতুন: অনেকে আছে। সারা দুনিয়াতেই আছে।

প্রশ্ন

আপনারা এখনো ঘুরে বেড়ান, একত্র হোন এবং অনেক সেবা করেন।

শাহলা খাতুন: অসুখ হয়, হাসপাতালে যায়-আসে, সেবা করে ওখানেও তারা। আমার এক ফ্রেন্ড, ওখানে আবার… বহু আগেই উনি মারা গেলেন কিডনি ডায়ালাইসিসে। সে ছিল ওবি (স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ ডাক্তার) এবং বহু কাজ করে গেছে আমাদের ডাক্তারদের জন্য। আরও আছে, অনেকেই করছে, খালি যে একজন করে তা না। তবে আমরা যারা পড়াশোনা করেছি, প্রত্যেকেই কাজ করেছি, সার্ভিসে। কেউ যে চলে গেছে বা বিয়ে করে বাড়িতে গিয়ে বসে থাকছি, তা না।

প্রশ্ন

তারপর আপনি বলছিলেন যে ’৬১ সালে পাস করেই আপনি পাকিস্তানের যে হেলথ সার্ভিস, সেখানে জয়েন করেন?

শাহলা খাতুন: বলত যে ইস্ট পাকিস্তান আপার সার্ভিস। আপার হলেও ক্লাস টু। (হাসি)

প্রশ্ন

সেটাতে চাকরি নিলেন। চাকরি নিয়ে আপনার পোস্টিং কোথায় হলো?

শাহলা খাতুন: ঢাকা মেডিকেল কলেজ। যত দিন ছিলাম ইস্ট পাকিস্তানের সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজেই ছিলাম। তখন আমাদের পোস্টিং ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজে আর কিছু বোধ হয় সিভিল সার্জন হতো। ওখান থেকে আমি ’৬৫-এর ডিসেম্বরে চলে গিয়েছিলাম। এমন কো-ইনসিডেন্ট আমি দেখলাম, আমি ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান থেকে রওনা দিয়ে লন্ডনে গিয়েছিলাম, ১৬ ডিসেম্বর! ’৬৫-তে।

তো ওখানে ছিলাম। ওই জায়গায় কিছুদিন পড়াশোনা করলাম, চাকরি করলাম। আমি আবার সব জায়গায় গিয়ে ট্রেনিং নিয়েছি। অনেকে নেয়নি, গিয়ে খালি পড়েছে আর পরীক্ষা দিয়েছে। আমি তা করিনি। আমি চাকরি করেছি পুরো ওদের সাথে, কমপিটিশন দিয়ে।

প্রশ্ন

১৯৬৪ সালে আপনার সহপাঠী ড. শেখ হুমায়ূন কবীরের সঙ্গে বিয়ে হলো। উনি ডাবল এফআরসিএস ছিলেন।

শাহলা খাতুন: ইয়াংগেস্ট।

প্রশ্ন

ইয়াংগেস্ট! যখন বিয়ে হয়, তখন তো এফআরসিপিএস ছিলেন না?

শাহলা খাতুন: না, তখন না। তখন তো জাস্ট আমরা দুজনেই ঢাকা মেডিকেল কলেজে চাকরি করি।

প্রশ্ন

তারপর আপনি, আপনারা দুজনেই কি লেখাপড়ার জন্য, উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেতে গেলেন?

শাহলা খাতুন: দুজন স্কলারশিপ নিয়ে গেলাম। অবশ্য আগের দিনে আরেকটা করত কী, স্টুডেন্টদের লাহোরে পাঠাত পার্ট ওয়ান করার জন্য। তখন এফসিপিএসের দুইটা পার্ট ছিল, সার্জারির। তো পার্ট ওয়ানটা লাহোরে পাঠাত। ওকে লাহোরে পাঠিয়েছিল। লাহোর থেকে পার্ট ওয়ান করে এসে আবার ছয় মাস পরে লন্ডনে যায়। আমার আগে গিয়েছিল। ও বোধ হয় জুনে গেল, আমি গেলাম ডিসেম্বরে। কারণ, আমাদের আবার তখন নিয়ম ছিল পাকিস্তানে জিন্নাহ পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল কলেজের আমাদের একজন বস ছিলেন, ওনার চিঠি আসতে হতো। না হলে যেতে পারতাম না। তো ওনার চিঠি আসতে দেরি হচ্ছিল কোনো কারণে। তারপর আসার পরে চলে গিয়েছিলাম।

প্রশ্ন

উনি সার্জন ছিলেন?

শাহলা খাতুন: হ্যাঁ। উনি এফআরসিএস—মানে সার্জন। ফেলো অব রয়্যাল কলেজ অব সার্জন।

প্রশ্ন

আর আপনি গাইনোকোলজিস্ট হলেন?

শাহলা খাতুন: হ্যাঁ, আর আমরা হলাম মেম্বার রয়্যাল কলেজ অব অবস্টেটিশিয়ানস অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্টস। এরপর আরও বহু রকম ডিগ্রিটিগ্রি, সেগুলো আলাদা।

প্রশ্ন

আরও অনেক ডিগ্রি নিয়েছেন। তারপরে লন্ডন থেকে দেশে ফিরলেন কত সালে?

শাহলা খাতুন: ’৬৮-এর অক্টোবরে। তখন আমার মেয়ের বয়স এক বছর। আমি পাকিস্তানে আসি, মানে লন্ডন ছাড়ছি। করাচি থেকে মুহিত ভাই তখন পিন্ডি ছিলেন। মুহিত ভাইদের তখন ক্যাবিনেট পিন্ডি চলে গিয়েছিল। তো উনি এক মাস (লন্ডন থেকে) আসতে দেননি। বললেন, ‘না, এখন গরম, মেয়ে সহ্য করতে পারবে না। একটু ঠান্ডা পড়ুক।’ আর তা ছাড়া আমার আব্বা-আম্মাও গেলেন তখন, একসঙ্গে এলাম।

প্রশ্ন

দেশে ফেরার পরে আপনাদের খুলনায় পোস্টিং হলো?

শাহলা খাতুন: খুলনায় পোস্টিং হলো। আমরা তো গভর্নমেন্ট সারভেন্টই ছিলাম।

প্রশ্ন

রাইট।

শাহলা খাতুন: তো খুলনায় আমাদের সময় ফার্স্ট কনসালট্যান্ট পোস্টটা ক্রিয়েট হলো। আমরা যারা পোস্টগ্র্যাজুয়েট করে এসেছি, তাদের ডিস্ট্রিক্টে পাঠানোর জন্য। ইকুইভ্যালেন্ট টু অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। তো আমরা ফার্স্ট ব্যাচ অব কনসালট্যান্ট খুলনায় গেলাম পোস্টিংয়ে।

প্রশ্ন

খুলনায় গিয়ে দুজনই মানুষের সেবা করতে লাগলেন।

শাহলা খাতুন: খুলনা থেকে ঢাকা আবার আসা-যাওয়া করছি। এর মধ্যে আমার ছেলে হলো ঢাকাতেই।

প্রশ্ন

আপনার দুই ছেলে-মেয়ে?

শাহলা খাতুন: হ্যাঁ…

প্রশ্ন

সায়ীদ কবীর ছোট?

শাহলা খাতুন: ছোট ছেলে। ও হলো বাংলাদেশে ’৬৯-এ। আর মেয়ে হয়েছে লন্ডনে স্টুডেন্ট থাকাকালীন ’৬৭-এ।

বাংলাদেশের নারী চিকিৎসকদের মধ্যে প্রথম জাতীয় অধ্যাপক ডা. শাহলা খাতুন
প্রশ্ন

আপনার মেয়ের নাম কী?

শাহলা খাতুন: লুবনা কবীর।

প্রশ্ন

লুবনা কবীর প্রথম এমবিএ করেছেন হার্ভার্ড থেকে, বাংলাদেশ থেকে প্রথম?

শাহলা খাতুন: ফার্স্ট বাংলাদেশি মেয়ে, যে হলিক্রস স্কুল থেকে পাস করে ওখানে গিয়ে এমবিএ করেছে।

প্রশ্ন

আর সায়ীদ ভাই, সায়ীদ কবীর? এবং সাত মাস যখন উনার বয়স, তখন তার বাবা…

শাহলা খাতুন: ডক্টর শেখ হুমায়ুন কবীর মারা যান।

প্রশ্ন

খুলনাতে রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা যান।

শাহলা খাতুন: রোড অ্যাকসিডেন্টে—যশোর টু খুলনা।

প্রশ্ন

ওই যে প্লেনে করে উনি যশোর থেকে ঢাকায় আসতেন। এই যশোর টু খুলনা এই পথে মারা গেছেন, না? গাড়িতে ছিলেন।

শাহলা খাতুন: মৃত্যু এভাবেই হয়।...হেলথ মিনিস্টার পদে ছিলেন বহুদিন, নাম ভুলে গেছি, সিনিয়র, অনেক অনেক সিনিয়র। তো উনি, উনারা নাকি শেখ মুজিব যাচ্ছিলেন যশোর না খুলনায়। তো উনারা সব গাড়ির বহরে। উনার গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করছিল। উনি বলছিল আমাকে, আমাকে রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিয়ে সুস্থ করল, আর হি ডাইড।

প্রশ্ন

১৯৭০ সালের ১৬ জুন উনি মারা গেলেন। তারপর আপনি ঢাকায় বদলি হয়ে চলে এলেন?

শাহলা খাতুন: হ্যাঁ, আমাকে তখন আবার পিজিতে নিয়ে এল বদলি করে। আবার কাজ শুরু করতে হলো। সেপ্টেম্বরে বোধ হয় শুরু করলাম কাজ।

প্রশ্ন

আপনি তো ওই সময়ে বিলেত থেকে ডিগ্রি নেওয়া গাইনোকোলজিস্ট, অনেক সুনাম হলো আপনার, তাই তো?

শাহলা খাতুন: সার্ভিস করছি।

প্রশ্ন

সার্ভিস করার পরে এই রোগী দেখেছেন তো বাইরে?

শাহলা খাতুন: প্রথম তো হাসপাতালেই দেখেছি। আমাদের সময় একবার হাসপাতাল টাইম করল—এই বাংলাদেশ হওয়ার পরে—সকাল সাতটা থেকে বিকেল চারটা। তো ওটা বেশি দিন টিকাতে পারেনি, এটা বন্ধ করে দিল। তখন সাতটা থেকে চারটা ছিল, সুবিধা ছিল—সব রোগী দেখা যেত। এরপর তো আর রোগী দেখার সময় কুলাত না।

আমার সিনিয়র তিনজন স্যার—তিনজনই মারা গেছেন। একজন ন্যাশনাল প্রফেসর ডক্টর নুরুল ইসলাম। একজন, উনি আবার এমপিও ছিলেন—প্রফেসর মান্নান। আরেকজন ছিলেন প্রফেসর। উনি সবচেয়ে পরে মারা গেলেন—প্রফেসর নাজিম-উদ-দৌলা। তো উনারা চিঠি লিখে দিতেন রোগীকে, রোগী দেখে না তো, আমাদের কাগজ দেখালে দেখে দেবে। এই করে করে শুরু করলাম প্র্যাকটিস। স্যারদের পাঠানো রোগী দেখে দেখে। প্রথম বাবর রোডে ওখানে ছিলাম, গভর্নমেন্ট অ্যালোটেড, ওখানে দেখতাম। এরপর পাশে ওটার নাম ছিল খিলজি রোড। খিলজি রোড, বাবর রোড পাশাপাশি।

তো বাবর রোডের ওখানে একটা বাড়ি ছিল… আমি তখন ওই বাড়িটাতে খিলজি রোডে শুরু করলাম প্র্যাকটিস।

প্রশ্ন

তাহলে তো একটা জেনারেশন আপনার হাত দিয়ে হয়েছে, নাকি?

শাহলা খাতুন: বহু। জেনারেশনের পর জেনারেশন। সেদিন পেলাম একজন আসছে, সে তো হয়েছে হয়েছে, তার বাচ্চারাও নাকি হয়েছে। ডাক্তার।

কালকেও একজন ফোন করল। ভুল করে ফোন চলে গিয়েছিল। (আমি চিনতে পারিনি) বলে, ‘আপনি না চিনলে কী হবে? আমরা তো চিনি। ভুল করলেও ভালো। আমি খুশি যে ফোন এসেছে।’ হয় অনেক সময়, স্বাভাবিক।

প্রশ্ন

আপনার ১৯৭১ সালের কথা মনে আছে?

শাহলা খাতুন: হ্যাঁ, ’৭১ সালে ছিলাম সোবহানবাগ কলোনিতে। …আমার ছোট বোন তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ত, ঢাকা ইউনিভার্সিটি, হিস্ট্রিতে। আমার ভাই ডক্টর এ কে এম মোমেন। সে তখন আমার সঙ্গে ছিল ওখানে। সে বলল, ‘এখানে থাকা যাবে না, আমরা সিলেট চলে যাই।’ আমার বোন ইউনিভার্সিটি হোস্টেলে ছিল। আমার দুই বাচ্চা, আমি, আমার বোন আর ভাই—আমরা সিলেট চলে গেলাম। সিলেটে গেলেও তখন সব জায়গায় তো একই অবস্থা।

ফোরথ এপ্রিল, ’৭১ সাল মনে রাখব। আমার বাড়ির পাশে দুটি রাস্তা। এদিকে একটা রাস্তা গেছে, ওই দিকে একটা। এই রাস্তা দিয়ে তামাবিল, সোজা চলে গেছে শিলং। আমরা শিলং গেছি। তো ওখানে একটা লাইট পোস্ট ছিল। তো ওখানে এসে পাকিস্তানি গাড়ি এলার্ন করত। এলার্ন হলো, সন্ধ্যা ছয়টা থেকে কারফিউ। ওরা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই…

আমাদের বাড়িটা ওই যে, মনে করো এটা আমার বাড়ি, আগের দিন ওসব থাকত না…ড্রেন, যেটাকে খাল বলে। ওরকম বেশ বড় এ রকম খাল। তো ওখানে রাস্তাও রাস্তা দিয়ে যেতে গেলে যে কালভার্ট দিয়ে যেতে হয় না? ওরা ওখানে নিচে বসে ছিল।

আমাদের অনেক গাছ ছিল। আসলে ফুলের বাগান ছিল। আমার বড় ভাই মুকসিয়া অসম্ভব বাগান করতেন। সারা উঠান বাগানে ভর্তি ছিল, কিছু দেখা যেত না। ওরা ওখান থেকে গুলি করছিল ওই বাড়িতে। ওরা গুলি করার পরে অটোমেটিক্যালি তখন এরাও (ইপিআর) গুলি করতে শুরু করল। ওদের হাতে অত বেশি গুলি ছিল না। এরা করত কী, একটা কি দুইটা মারত। বেশি তো নাই। আমাদের তখন বলত ইপিআর। আচ্ছা, মোমেন কোথায় যেন ছিল। খবর পাইছে। ওরা তাকে খুঁজছিল কী করবে। ও এসে পেছন দিয়ে কেমনে কেমনে যেন বাড়ি টপকিয়ে ঢুকছে। আমাদের সামনের ঘরে গুলি ঢুকছে। এ রকম করতে করতে তখন প্রায় রাত আটটা বেজে গেছে। তখন বৃষ্টি আসছে। আর বৃষ্টি আসছে, ওদেরও তখন বারুদ শেষ। তো ওরা চলে গেছে সেই এয়ারপোর্টে… আর তখন সবাই বলছে যে আমাদের সামনে একটা ব্যারিকেড করেন। তা আমাদের বাসার রাস্তার সামনে। ও পাশে হলো বড় পুকুর। ধোপাদিঘির পুকুর। এখন পুকুরটুকুর নেই। তো এরপরে ওখানে দূরে টুওয়ার্ড দ্য বাজার, বন্দর বাজার বলত আমাদের সিলেটে, ওখানে ব্যারিকেড দিয়ে রাখছিল।

বাংলাদেশ মেনোপজ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক শাহলা খাতুন এক সেমিনারে বক্তব্য দেন
প্রশ্ন

আপনাদের বাড়িতে তো আক্রমণ করে...

শাহলা খাতুন: করেছে। আমরা তো ঘরে। এক ঘর ভাঙে, এক ঘরের দরজা-জানালা ভাঙে। ভেতরে যেতে গিয়ে। স্টোর রুমে আর খাটের নিচে একদম লাস্ট খাবার রুমের। খাবার রুমটা অনেক বড়। একটা খুব ভালো স্টোর রুম ছিল আর খাট বিছানা ছিল। ওটাতে আমি ঘুমাতাম। … আসছে রাতেও। সকালবেলা প্রতিবেশীরা সব চলে গিয়েছিল আগেই, পালিয়েছিল। এসে বিশ্বাস করেনি যে এই বাড়িতে মানুষ বেঁচে আছে। আমরা বেঁচে ছিলাম, কেউ মরিনি। তখন আমরা সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার এই হলো আমার বাসার পাশে অন্য বাসা। তো জাস্ট রাস্তা ক্রস করে আমরা অন্য বাসায় চলে গিয়েছিলাম। ওটা কিন্তু কিছু—মানে কিছু হয়নি। আর আসল হলো—আচ্ছা, তারপরে বলছি। তারপর ওখানে এক রাত থাকার পরে ঠিক হলো, বহু মানুষ ওখানে থাকা যাবে না। তো আমরা তখন কোনো রকমে আমার ভাই আমাদের নিয়ে গেল আমার মামা ডক্টর সৈয়দ আরশা আনোয়ার। উনি আবার চৌধুরী ছেড়েছিলেন। যেহেতু চৌধুরী বেশি হয়ে গেছে। উনার বাসায়। তো উনি আবার খাঁটি আওয়ামী লীগার। তখন সবাই বলল, ‘এই বাসায় থাকা যাবে না।’ আর এদিকে উনার ছেলে—মানে আমার ফুফাতো, এক ফুফা আরেক ফুফাতো ভাই, সে আবার মুক্তিযোদ্ধা। ওরা আবার তখন আসছে আমাদের এসে বলল, ‘না, এখানে তোমরা থাকতে পারবে না। আমরা এখন জেল অ্যাটাক করব। জেল কাছে। জেল অ্যাটাক করব আমাদের লোকদের যাদের অ্যারেস্ট করছে, তাদের বার করার জন্য। তো তোমরা পালাও। এখন কোথায় পালাব? তখন কইলাম, ওই যে করল, তার বাসাতেই। ওটা হলো আরেকটু ভেতরে। ওখানে এক রাত ছিলাম। সকালবেলা ওই আমাদের রাত মানে কী? কোনো রকমে। ও মাঝখানে একটা কাঠের গুদামে থাকলাম। তারপরে ওদের বাসায় যে বলল, সে তার বাড়িটাতেই যায়নি। সে বলল যে তোমরা...সে একটা গাড়ি দিল। বিশেষ করে ওই যে আমার বোন একটা অসুস্থ হয়েছিল। আম্মা আসতে পারবে না। আমিও বোধ হয় পারব না। আমার মামীও ছিলেন একজন।

ওখান থেকে আমরা একটা গাড়ি দিয়ে চলে গেলাম ফুলবাড়ি।

প্রশ্ন

ফুলবাড়ি।

শাহলা খাতুন: প্র্যাকটিক্যালি ফুলবাড়ি ছিল। ইন্ডিয়ান রেডিও অ্যানাউন্স করল যে আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ, অ্যাডভোকেট—এ রকম একটা নামীদামি মানুষ, যার এত কন্ট্রিবিউশন এই দেশ তোমাদের পাকিস্তান গড়ার, তাকে মেরে ফেলছে পাকিস্তান বাহিনী। তার বাড়ির কোনো ভাঙা ফটো দিয়েছে আর বলছে যে যে এখানে তার কোনো কারো কোনো খবর পাওয়া যায় না। তখন ঢাকায় বস অব দ্য পাকিস্তান আর্মি। সে আমার ভাই সুজন মুইজ... ওকে কেমনে খুঁজে বার করল! ও তো সাধারণ বিমায় চাকরি করত। ওকে খুঁজে বের করে সিলেট পাঠালো দেখতে যে কোথায় আমরা। আর ওদিকে ওসব বলার পরে আব্বা সবাই অসুস্থ হয়ে গেল। আব্বা, আম্মা, আমার ছেলে সায়ীদ কবীরের খুব বেশি অসুখ হলো। আব্বা ঠিক করলেন যে মরতে হয় বাঁচতে হয়, নিজের বাড়িতে যাওয়াই ভালো। আব্বা ঠিক করে আমরা চলে আসছিলাম ২৯ এপ্রিল। ৪ তারিখ, আর্লি মর্নিং ৫ তারিখে চলে গিয়েছিলাম। বাড়ি কিছু ছিল নাকি? বাট আমরা এখানে এসে গেছি। একটা ছেলে ছিল আমাদের সঙ্গে কাজ করত, পিজি থেকে তার বড় ভাই আমাদের দিছিল। অসুস্থ সে। কিন্তু আমার ছেলেকে এক সেকেন্ডের জন্য কোল থেকে সরাতো না। যেখানে যাইত, ওখানে কোলের মধ্যে করে দিয়ে এভাবে বাঁচিয়েছে মানুষ আমাদের।

প্রশ্ন

তারপরে ’৭২ সালে আপনি...

শাহলা খাতুন: তারপরে ’৭১ সালেই জুন-জুলাইতে আমাদের অর্ডার দিল, সবাইকে চাকরিতে জয়েন করতে হবে। তখন চলে এলাম আমরা আবার সবাই। সব জায়গা থেকে, যে যেখানে ছিল। তখন একটু কী (পরিস্থিতি স্বাভাবিক) ছিল। তারপরে আবার ডিসেম্বরে গেলাম।

প্রশ্ন

তারপরে আপনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে জয়েন করলেন ’৭২ সালের পরে?

শাহলা খাতুন: ওখানে পিজিতে।

প্রশ্ন

তখন ডাক্তারি করছেন, পড়ানো শুরু করেছেন?

শাহলা খাতুন: সবই। পড়ানো আমরা অত বেশি পারিনি। তখন স্টুডেন্ট-টুডেন্ট ছিল না।

প্রশ্ন

’৭২-এর পরে? ’৭৩-’৭৪-এর দিকে?

শাহলা খাতুন: আমাদের অর্ডার দিল যে পরীক্ষা নিতে হবে, ’৭১-এ। ’৭১-এ পরীক্ষা দেবেটা কে? কেউ তো নেই, দুই-চারজন ছাড়া।

প্রশ্ন

মুক্তিযুদ্ধের পরে কী হলো, স্বাধীন দেশে?

শাহলা খাতুন: তারপর স্বাধীন হওয়ার পর আমরা ওই ব্যাচের পরীক্ষা আবার নিলাম। এর মধ্যে ছিল মোদাচ্ছের আলী, এরা সবাই। ওদের পরীক্ষা তারা তখন দিয়েছে বাধ্য হয়ে।

প্রশ্ন

টিচার হিসেবে আপনার তো অনেক সুনাম।

শাহলা খাতুন: পড়াশোনা করেছি। এইম (লক্ষ্য) আমার জীবনের, টিচার হব। খারাপ টিচার নাকি ভালো টিচার, জানি না। তবে আমি আমার মতো করে কাজ করে গিয়েছি। আমি যেটা করতাম সেটা হলো, আমি টাইম মেনটেইন করতাম।

প্রশ্ন

ঠিকমতো পড়াতেন, ক্লাস নিতেন, ফাঁকি দিতেন না, পরীক্ষা ঠিক সময় নিতেন, খাতা ঠিক সময় দেখতেন, না কী?

শাহলা খাতুন: খালি খাতা দেখতাম না। সিনিয়র টিচাররা মার্ক দিতেন। একজন দিয়েছেন ২, একজন দিয়ে রাখছেন ১২। তো এগুলো ভাই আমার কাছে আসছে, থার্ড এক্সামিনার ছিলাম। করেছি বহু কিছু জীবনে। আমার মনে হয় না অনেকে এত করছে। তারপরে আবার খালি যে এমবিবিএস-এফসিপিএস ডিজিও না, আমি ফার্স্ট বাংলাদেশি পিএইচডি ছাত্রীর টিচার গাইড ছিলাম। আমি নিজেই জানি না ভালো, পিএইচডি! … শিখছি আগে।

প্রশ্ন

সেটা কোথায় করলেন? ঢাকাতে?

শাহলা খাতুন: পিজিতে। আশরাফুন্নেসার নাম শুনছেন কি? আশরাফুন্নেসা আছে এখন আমাদের ক্যানসার বিভাগে, সারভাইক্যাল ক্যানসারে। তো সে আমার প্রথম ছাত্রী পিজিতে পিএইচডি।

প্রশ্ন

আপনি তাহলে পিজিতে জয়েন করলেন কবে?

শাহলা খাতুন: ওই যে বললাম, আমি তো সারা জীবনে পিজিতেই।

প্রশ্ন

পিজিতেই? মানে ঢাকায় যে পোস্টিং হয়েছে, এটা পিজিতেই? ঢাকা মেডিকেল কলেজে না?

শাহলা খাতুন: আমি বলি, ঢাকা মেডিকেল কলেজই ছিল পিজি। পিজি সব সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজে আগে ছিল। আর একটা অফিস ছিল ওল্ড ইউনিভার্সিটি ভিসির রুমে। ওখানে খালি বসতেন ডাইরেক্টর সাহেব, নুরুল ইসলাম সাহেব বা দু-একজন। আগে ব্রিটিশ ছিল, ফার্স্ট ডাইরেক্টর ব্রিটিশ।

প্রশ্ন

জি।

শাহলা খাতুন: তারপরও এটা তো বলিনি। ’৭১-এই তো। যখন একটু ভালোর দিকে, তখন আমাদের পিজি শিফট হলো শাহবাগে। পিজি শিফট হওয়ার পর আমাদের ডিপার্টমেন্ট আসতে একটু সময় লাগছে। ওখানে আমি একা শিফটের সময় লাঠি হাতে নিয়ে আমরা পেছনের লোক সরিয়েছিলাম। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত।

প্রশ্ন

১৯৭৪ সালে আপনি আমেরিকায় গেলেন এবং সেখানে আবার ইসিজিএমজি পরীক্ষা।

শাহলা খাতুন: ওদের পরীক্ষা, ওটা না দিলে চাকরি হয় না।

প্রশ্ন

কিন্তু থাকেননি, চলে এসেছেন।

শাহলা খাতুন: ওখানে চাকরি করছি ইউনিভার্সিটি হসপিটালে।

প্রশ্ন

কত দিন?

শাহলা খাতুন: এক বছরের মতো। ’৭৫-এ আসছি।

প্রশ্ন

’৭৫-এ আসলেন। এসে?

শাহলা খাতুন: আমি চলে আসছি—সত্যি কথা বলি, মুজিব মারা গেলেন। সেদিন সকালবেলা এতগুলো পেপার নিয়ে এল আমার বোনঝি জামাই। ও আবার ইঞ্জিনিয়ার। সব জায়গায় খালি মুজিব ডেড, মুজিব ডেড। আমি তখন ঠিক করলাম যে দেশে আসব। বাংলাদেশে যত সিনিয়র সেক্রেটারি বা কেউ আছে, সবাই ফোন করে বলে, ‘মাথা খারাপ নাকি তোমার? আমরা সব পালাতে চাই আর তুমি আসতে চাও!’ আমি এসে গিয়েছিলাম ডিসেম্বরে। সরি, আগস্টে।

প্রশ্ন

২০০১ সালে আপনি বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের...

শাহলা খাতুন: তখন চাকরি শেষ হলো আমার। ’৯৮-এ হলো ইউনিভার্সিটি। এর আগে তো পিজি ছিল। তারপরে আমার চাকরি শেষ হলো। সরকারি চাকরি শেষ হলো ২০০১-এর জুনে। তখন ওই বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজে...

প্রশ্ন

আপনি যোগ দিলেন।

শাহলা খাতুন: হ্যাঁ, ওখানে ছিলাম। তখন...

প্রশ্ন

গাইনি বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান হিসেবে।

শাহলা খাতুন: হ্যাঁ, মেজর জেনারেল আনিস ওয়াইজ ছিলেন। ওনার সঙ্গে পরিচয় অনেক আগে। ওনার আব্বা সিলেট এমসি কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। তা ছাড়া ওনার অনেক ভাইবোন আমাদের মতো। তো উনি একটা ফোন দিলেন, ‘আর কত সরকারের চাকরি করবে? আমাদের এদিকে চলে আসো।’ তো সত্যি সত্যি গেলাম।

প্রশ্ন

ডাক্তার এ এম খান সাহেব উনি আবার ২০০১ সালে…

শাহলা খাতুন: এক না, ১৯৯৭ …

প্রশ্ন

১৯৯৭ সালে উনি হার্ট অ্যাটাক করে এই যে বনানীর যে বাড়িতে আমরা কথা বলছি, এই বাড়ির সামনে মারা গেলেন।

শাহলা খাতুন: অল্প একটু সামনেই।

প্রশ্ন

উনি কি হাঁটতে গিয়েছিলেন?

শাহলা খাতুন: হ্যাঁ, সকালে হাঁটতেন।

প্রশ্ন

সকালবেলা হাঁটতে গিয়ে হার্ট অ্যাটাক করল?

শাহলা খাতুন: স্পট ডেড। সঙ্গে ছিলেন আমারই স্যার একজন, হার্ট ফাউন্ডেশনের।

প্রশ্ন

হার্ট ফাউন্ডেশনের হার্টের ডাক্তার সঙ্গে নিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আপনার দ্বিতীয় হাজব্যান্ড মারা গেলেন। ১৯৯৭ সালে। তারপরে, তার মানে আরও ২৮ বছর চলে গেল। এখন আপনি বাংলাদেশ মেডিকেলে এখনো আছেন নাকি ওখান থেকে…

শাহলা খাতুন: এখনো আছি। অনারারি চেয়ারপারসন অব দ্য ডিপার্টমেন্ট। আমার রুমও আছে, সব আছে।

প্রশ্ন

এখনো যান?

শাহলা খাতুন: এখন তো একটু কম যাই। গিয়েছিলাম কদিন আগে।

প্রশ্ন

এখন আর রোগী দেখেন না?

শাহলা খাতুন: রোগী এখন কোথাও দেখি না।

প্রশ্ন

আর এই ১৯৫৬ সালের ঢাকা মেডিকেল কলেজের ক্লাব, এদের সঙ্গে কাজ করেন?

শাহলা খাতুন: ওইটা আমাদের মিটিংটিটিং। আমার ওখানেই তারা এসে করে এখন। চেষ্টা করছি সরে যেতে। প্রেসিডেন্টশিপ থেকে এখনো কেউ সরাতে দেয় না। তবে সেক্রেটারি-টারিকে এগুলো বদলিয়েছি।

প্রশ্ন

এখন এই যে কাগজ আমার হাতে আছে। অনেকগুলো সমাজসেবার সঙ্গে যুক্ত—বিএমএ, বিপিএফ, ওজিএসবি, বিএমএস, পেরিনেটাল সোসাইটি।

শাহলা খাতুন: আমি নিজে এটা দেখে অবাক হয়েছি। এতগুলো থাকতে পারে নাকি? ৩৫টা এখানে দিয়েছে, আমি এখানে দেখছিলাম।

প্রশ্ন

এগুলোতে আপনি...সারা দিন আপনাকে...

শাহলা খাতুন: আবার অনেক কিছু করছি জীবনে…যেমন নন-গভর্নমেন্ট ইন্সপেকশন ইন্সপেক্টর অব ঢাকা জেল। এগুলো তো কেউ কোনো দিন করেনি।

প্রশ্ন

আপনি করেছেন?

শাহলা খাতুন: হ্যাঁ, আমি ছিলাম তো।

প্রশ্ন

যেতেন?

শাহলা খাতুন: তখন এরশাদকে দেখলাম বন্দী। যাব না কেন? ওখানে গিয়েই তো মাথায় ঢুকল…

প্রশ্ন

ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে গিয়ে দেখলেন যে এরশাদ সাহেব ভেতরে বন্দী।

শাহলা খাতুন: তারপর ওখানে গিয়ে আরেকটা জিনিস দেখলাম। একটা মহিলা লালমাটিয়ায় একজন ডাক্তার আর ওনার মেয়েকে মেরে ফেলেছিল। তো সেই খুনি মহিলার সঙ্গে জেলে তখন থাকত কিছু সেফ কাস্টডি। ছোট ছোট মেয়েরা বাইরে গেলে…ওদের সঙ্গে ওই মহিলাকে রেখে দিয়েছে। আমি তো দেখেই প্রথম অবজেকশন দিলাম যে, ‘এটা তো হতে পারে না, এটাকে আলাদা করো।’ তারপরে আলাদা করল।

তার থেকে মাথায় ঢুকল যে বাচ্চাদের জন্য করছিলাম গাজীপুরে সেন্টার ফর...আমি তখন নাম দিয়েছিলাম...এখন ওটার অন্য নাম হয়ে গেছে।

প্রশ্ন

তো আপনার এখন তো মোটামুটি অবসর জীবন…

শাহলা খাতুন: সবকিছুতেই দেখলাম কিছু ভালো কাজ করলে কেউ না কেউ আসে।

প্রশ্ন

সুন্দর একটা জীবন চলছে, কাটাচ্ছেন।

শাহলা খাতুন: এই খালেদা জিয়া ছিলেন। আমি যখন গাজীপুরে ওটা (সেফ হোম) করব। কেউ তো ওনার কাছে যাওয়ার সাহস পায় না, আমাকে পারমিশনও দেবে না ওনার সঙ্গে দেখা করতে। আমি রিকোয়েস্ট করে করে ওনার লোকদের বললাম, ‘আমি একটা কাজে আসছি, তোমরা খালি আমাকে একটু...’ অফিসে গেলাম। ভদ্রমহিলা সাথে সাথে…কোনো প্রশ্নই করেননি। আসলে লোকগুলো জ্বালায়।

প্রশ্ন

বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করলেন। উনি তখন…

শাহলা খাতুন: জাস্ট ওনার রুমে ঢুকতে দেখেই আর কিচ্ছু না, সাথে সাথে পারমিশন দিলেন জায়গার। অত টাকা দিয়ে তো নিজে কিনতে পারব না, সরকারি (সহায়তা লাগবে)। এবং এটা তো এখন এত বড় একটা হয়ে গেছে, সেফ হোম। সেফ হোমের নাম এখন অন্যটা। নর্থ আমেরিকার মেইনলি ইঞ্জিনিয়ার, ওরা এটা চালায় এখন। টাকা দেয়। ওই ডক্টর মুবিন, আমার ভাই এটার সেক্রেটারি। ও এখন চেয়ারপারসন বোধ হয় এখানকার। তার মেয়ে গিয়ে সার্ভিস দেয়।

প্রশ্ন

এখন জীবনের অভিজ্ঞতা আমাদের বলেন। যারা নতুন প্রজন্মের ডাক্তার, তাদের উদ্দেশে কিছু বলেন।

শাহলা খাতুন: আমি একটা কথাই বলি—জীবন আমাদের একবার। যতই অসুখবিসুখ হোক না কেন, আল্লাহ তাআলা ঠিক করে রাখছেন আমাদের নেবেন একসময়। সেটা ঠিক আছে। ওটা নিয়ে আমি খুব একটা কী করি না। জানি যে হবে। তবে ডেফিনেটলি সব সময় আমরা নামাজ-রোজা করি। বলি, সুস্থ-সালামতের সাথে যেতে পারি আমরা। এটা তো সবাই আমরা করি।

তবে আমি আমার জুনিয়রদের এখন একটা কথা বলি। কারণ, আমি এটা নিজে বুঝেছি। শুধু রোগী দেখছি, সকাল নেই, বিকেল নেই। আমার একটা ভাই আমার সঙ্গে থাকত, আমি যখন মোহাম্মদপুরে ছিলাম। আমেরিকাবাসী আমার সবচেয়ে ছোট ভাই, সেভেন্থ ব্রাদার, ফ্যামিলির মধ্যে সে বোধ হয় ১১ নম্বর। সে বলত, ‘আচ্ছা আপা, তুমি কখন উঠে রোগী দেখতে যাও? আমরা তোমার বাসায় থাকি, এক দিনও আমি বুঝি না।’ এটা ছিল আমাদের (সময়ে), মানে কেমনে রোগীর সেবা করব, আর কিচ্ছু না। এখন এটা বলি, না, রোগীর সেবা তো করবই। আমি না গেলে আরেকজন না একজন আছে। কিন্তু নিজের সেবা করা লাগবে। নিজের আর হলো ফ্যামিলির, এটা হলো ফার্স্ট ডিউটি। ইউ শুড লুক আফটার ইউ। তোমার সেফটির ওপর ডিপেন্ড করছে মানুষের সেফটি। আর ফ্যামিলি, ফ্যামিলি ইজ ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট। ফ্যামিলি ছাড়া কেউ কখনো মানুষ হতে পারে না, হু এভার ইট ইজ।

তারপরে তুমি ডেফিনেটলি তোমার ওয়েল-উইশারস, ডাক্তার, বন্ধুবান্ধবের সেবা করবে। আর যখন তুমি ডাক্তারি করবে, তখন কিন্তু গল্প করবে না। আমি এটা কেন বলি, আমার এক ডাক্তার খুব নামীদামি। তো আমার ছোট বোন ডায়াবেটিক। আমার টুয়েলভথ সিস্টার। তো ও (একজন ডাক্তারের) কাছে যায়, সব সময় দেখায়। তো গেলেই যে (ডাক্তার) দেখে, তার মা আবার আমার আরেক বোনের ক্লাসফ্রেন্ড ছিল। গেলেই খালা খালা করে শুরু হয়ে গেল। এর ফলে হলো কী, আমার ওই বোন কোনো দিন জানত না যে ডায়েট একটা চার্ট আছে।

প্রশ্ন

ওহ, গল্পের তালে ভুলে যেতেন।

শাহলা খাতুন: তো ও (ডাক্তার) একবার ছিল না, অন্য কোথায় দেখিয়েছে, গুলশানে থাকে। আমাকে বলে, ‘আচ্ছা আপা, আমাকে তো বলল এখানে ডায়েট চার্ট, আমার তো এটা নাই।’ তখন আমি বুঝলাম, ফার্স্ট তোমার ডিউটি। তোমার কাছে আসছে পেশেন্ট, তুমি তাকে দেখো। তার (সম্পর্কে) যত রকমের তোমার কাছে মনে হয় জানা দরকার, জানো। তারপরে যদি তুমি চাও…

প্রশ্ন

আগে চিকিৎসা কাজটা সেরে তারপর…

শাহলা খাতুন: এই যে পার্সোনাল লাইফের এক্সপেরিয়েন্স এটা। এটা এখন সবাইকে তাই বলি। আমার ডাক্তারদের বলি যে, ‘গল্প পরে। গল্প করব না কেন? আমরা মানুষ। করবই কিছু না কিছু।’ (এই ঘটনাতে) আমিও লজ্জা পেয়েছিলাম যে আমার হাসপাতালটাতে… অন্যদের বেলায় হয়নি, এটাতে হয়েছে। এগুলা হলো এক্সপেরিয়েন্স, এ জন্য বললাম। আমি বলি সে জন্য কারণ আমার কাজ। আমি লিখছি এক জায়গাতে হয়তো পাবেন, বের হবে। অনেক সময় কিছু ব্রেভ বলব ওরা ভলান্টারি সার্ভিস দেয়। ভলান্টারি বলব না, তারা মানবতার সার্ভিস দেয়। টাকাপয়সা নেয়, সেটা আলাদা। তাদের কাজ হলো, তুমি থাকবে রোগীর সাথে। তাদের কাজ হলো, রোগীর সাথে কনস্ট্যান্টলি…যার যখন ডিউটি, কনস্ট্যান্টলি তোমাকে আট ঘণ্টা থাকতে হলে আট ঘণ্টা থাকবে, সে কেমন আছে, দেখো। তার গায়ে একটু হাত দাও। মাদার তেরেসা বলে গেছেন যে, ‘মরণ পথিক যে হবে, তাকে আমরা বাঁচাতে পারব না। তবে যদি আমরা তার হাত ধরে তার কাছে একটু বসি, সে নিশ্চিন্ত মনে মরবে। তার কোনো ভয় হবে না।’ তো আমি বলব, এটা করো। আর এইটা করবে না। কী করবে না?

এই যে আপনি ডাক্তার। ও আপনার রিপোর্ট কী বলে? তো রিপোর্টে আপনি অন্য ডাক্তার দেখাবেন না? আরেকটা ডাক্তার দেখান না কেন? তাহলে তো আপনি ভালোই যেতে পারতেন। তো আমি লিখছি এভাবে, ‘দয়া করে ডোন্ট আস্ক এগুলা। এগুলা আপনার ডিউটি না। আমরা যে ডিউটির জন্য আসছি, আমাদের ডিউটি আমাদের করতে দিবেন। আর অন্য ডিউটি অন্য জায়গায়।’ তো এটাও আমি লিখে দিছি, ওটাও পাবেন। যে আমার কাজ এইটা। ওগুলো জিজ্ঞেস করা আমার কাজ না। ওটা ডাক্তারের কাজ। ডাক্তার করবে, সে জানে। বা রোগীর পার্টি জানে, সে ডাক্তার বদলাবে কি না। তো এই হলো আমার লাইফের এক্সপেরিয়েন্স।

প্রশ্ন

ভেরি গুড। এখন আপনি তো একজন গাইনোকলজির গুরু।

শাহলা খাতুন: সেটা আমি মনে করি।

প্রশ্ন

তো আমাদের কিশোরী, মা এবং নারী যাঁরা আছেন, তাঁদের উদ্দেশে কিছু স্বাস্থ্যের টিপস দেবেন কি না।

শাহলা খাতুন: বলি। শিশু হাসপাতাল আছে, আপনি জানেন। ঢাকা শিশু হাসপাতাল নামীদামি। আমি ফার্স্ট বাংলাদেশে ইনস্টিটিউশনাল অ্যাডোলেসেন্ট ইউনিট খুলেছিলাম, আমি যখন ওখানে ডাক্তার ছিলাম, আমি ওখানে ছয় বছর ছিলাম অনারারি চেয়ার, সবকিছুর চেয়ারপারসন। তো আমি একতলায় দুই পাশে দুইটা রুম করে ওখানে তখন যা আজেবাজে ছিল তা বিদায় করে এক পাশে ছেলেদের, এক পাশে মেয়েদেরটা করেছিলাম। এটা তখন চলছিল। গভর্নমেন্ট তখন চিন্তা করছে যে করবে কি না। নামে তখন করেছে, কিন্তু কাজে কোথাও ছিল না। ওই দুইটা ইউনিট আমি ফার্স্ট বাংলাদেশের একদম প্র্যাকটিক্যাল করেছিলাম। এটা হলো একটা। তো সেটাও আমি মনে করি, অন্যরা করেনি। কারণ, আমি দেখছি যে এদের জন্য অসম্ভব দরকার। কারণ, টিনএজাররা হলো আমরা সবাই জানি সবকিছুর জন্য…জীবন আজকাল তো টিনএজাররা ডেফিনেশন (নাকি ডিফাইন) করে দিছে। তারা শুরু করছে নয় থেকে বোধ হয় বা ১০ থেকে ২৪ পর্যন্ত, অ্যাডাল্ট টিনএজার যারা। কেউ কেউ বলে ২৭-ও। যাই হোক, তাদের এত বড় একটা সময়, কত রকমের প্রবলেম হয়, যেটা তারা বলতে পারে না কাউকে, লজ্জা পায়। আর সব রকম ফিজিক্যাল, সাইকোলজিক্যাল—মানে মাসিক শুরু হয়, তারপরে আবার বাচ্চা হয়, সবকিছুই তো এই সময়। তো এটা তো কিচ্ছুই জানে না। তো এগুলো শেখাতে হবে। এটা লজ্জার না, এগুলা প্র্যাকটিক্যাল লাইফের জিনিস। তো এটা আমি বলছি, মেয়েকে খালি বসে বসে শেখালে হবে না। তার সাথে তার গার্জিয়ান রাখো, তার বন্ধুবান্ধব রাখো, ভাইবোন রাখো, টিচার থাকো, থেকে শেখাও। আমাদের স্কুলে কিন্তু একটা স্বাস্থ্য পার্ট আছে। এটা আমাদের টিচাররা এরকম করে বন্ধ করে রাখে, পড়ায় না। তো এটা আমি বলেছি, পড়াতে হবে। কারণ, জানতে হবে তো। না জানলে কী করে তারা নিজেকে সেভ করবে? জানলে সে জানে, আমি এটা করব। তো এটা কতটুকু হচ্ছে, জানি না। তবে আমরা চেষ্টা করছি এটা নিয়ে. . ।

আরেকটা হলো বাচ্চাদের নিয়ে। আরেকটা হলো বয়স্কদের। বয়স হলে আগের দিনে…এক কাজই তো ছিল বিয়ে—আমার জন্মকাল থেকে দেখে আসছি ছোটবেলায় বিয়ে, স্কুল-টুল তো কিছু জানে না, আর কেমনে অর্ডার মানতে হবে এটা শিখিয়েছিল সবাইরে। ইভেন যদি বাড়িতে একটা ছেলে বয়সে ১০ বছরের ছোট হয়, ওরও অর্ডার মানতে হবে, কারণ ও ছেলে। সুতরাং ছেলেরা যা বলবে, ইউ মাস্ট ডু ইট। মায়েরা বললেও দরকার নেই। তো আমি সেটাও বলতেছি—করবে না। কারণ, হলো সবাই সমান আমরা। ছেলে যা, মেয়েও তা। তবে ডেফিনেটলি মেয়ের শরীর বাইরে অনেক রকম প্রকাশ পায়, যেগুলা ছেলেদের পায় না। পেলে অত কিছু হয় না। সুতরাং সবাই মনে করে যে এটা তো কিছু একটা জিনিস, কিছু একটা জিনিস। নাহ্, সেটা আল্লাহর দেওয়া। তোমাকে যেমন আল্লাহ চোখ, হাত, মুখ দিয়ে বানিয়ে দিয়েছে, মেয়েদেরও আল্লাহ এইভাবে বানিয়েছে। প্রথমে সে কিশোরী, তারপর সে একটা প্রাউড মাতা আর তারপর সে একটা বয়স্ক মহিলা, যাকে সম্মান করতেই হবে।

এটাও সত্যি, আগের দিনে ওই যে বললাম ৪০ বছর হলে আমাদের মেয়েদের মাসিক বন্ধ হয়ে যেত। তারপর মনে করত জীবন শেষ এবং সত্যি কথা বলতে অনেক জায়গায় তাদের জীবন শেষ করে রাখত। ঘরে জায়গা দিত না, বুড়া গরুর ঘরে গিয়ে ঘুমাত। তো সেটা বলছি, করবে না। সেটা বলেছে আরকি ওভাবে।

আরেকটা ছিল আগে ট্র্যাডিশনাল ছিল আমাদের—একটা বোধ হয় আছে ‘আলাপ’ নামে, খুব ভালো, তারা এইসব অ্যাডভাইস করে মেয়েদের। আর আরেকটা হলো, মেয়েরা সব রকম অ্যাডভার্স সিচুয়েশনে ওরাই বেশি এফেক্টেড হয়। তো এদের জন্য বোধ হয় আজকাল একটু আলাদা কী আছে, হেল্পলাইন। আর আরেকটা বলেছি মায়েদের জন্য। যেহেতু কারও কারও থার্টি আপ হলেই কিছু কিছু মায়েদের মাসিক বন্ধ হওয়ার আগের কিছু সিমটম এসে যায়। সবার আসে না। তাদের জন্য ৩৫ উর্ধ্ব ক্লাব করেছি, যাতে শেখানো যায়। আর আরেকটা করেছি ওই যে বাংলাদেশ মেনোপজ সোসাইটি। তো বাংলাদেশ মেনোপজ সোসাইটিতে বাংলাদেশ আগে লেখা। এ জন্য কিছুতেই আমাকে লাইসেন্স দিচ্ছিল না। আমি চেষ্টা করছি ১৯৯৫ থেকে। পারিনি, পারিনি। ২০০৫-এ গিয়ে পারছি। ওই বাংলাদেশ লেখা দেবে না। দিতে হবে মেনোপজ সোসাইটি অব বাংলাদেশ। তো এটা নিয়ে আমি ফাইট করলাম এই জন্য যে আমার ওয়ার্ল্ডে আমার ‘বাংলাদেশ মেনোপজ সোসাইটি’ বলে এটা নাম হয়ে গেছে, সব জায়গায়। তোমরা বদলালে তো পারবে না। আলটিমেটলি আমাকে কিন্তু দিয়েছে, নাম হলো বাংলাদেশ মেনোপজ সোসাইটি। তো মেনোপজ সোসাইটির কাজ ওই ৩৫ বছর বয়স থেকে শুরু করে দিতে বলেছি। যেটাতে ব্রিগেডিয়ার সুরাইয়াকে চিফ করে দিয়েছিলাম। আর ওখানে মেইনলি ছিল কিছু আর্মির ডাক্তাররা, যারা আমার সাথে কাজ করছে। আগে আমার ছাত্রীও ছিল, আমার সাথে কাজও করেছে। যাই হোক, তারা ভালো কাজ করছে। মিটিং-টিটিং মাঝে মাঝে আগে গিয়েছি। বেশি মিটিংই হয় ওখানে, আর্মি একটা কী আছে না… আমাদের রিটায়ার্ড আর্মি অফিসারদের। তো ওখানে আমিও ইনভলভ। যেহেতু আমিও রিটায়ার্ড আর্মি অফিসারের ওয়াইফ। তো ওখানে আমরা প্রায় মিটিং করতাম। সব ক্যাটাগরির লোক আসত, এ জন্য ভালো লাগত।

প্রশ্ন

আর সিজারিয়ানটা কম করা যায় কি না?

শাহলা খাতুন: সিজারিয়ানটা, এটা হলো আমাদের ধৈর্যের অভাব, সময়ের অভাব। একসাথে ১০টা খেতে চাই। আর কোনো কিচ্ছু না। সময় দেয় না। আমাদের হাসপাতালে, গ্রিন লাইফে আছে একটা মহিলা, এখনো চাকরি করছে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে। সে তো বসে থাকে। বসে থাকা লাগে না। আমাদের ট্রেইনড নার্স আছে। আমার একটা পুরো একটা টিমই আছে আমার হাসপাতালে। ও-ও নরমাল করার চেষ্টা করে এবং আমার আরও আছে যারা ফার্স্ট সিজার, সেকেন্ড নরমাল ডেলিভারি করে। সময় দিতে হয়। তো সবাইকে আমি করে ফেলব, আমি কোনো দিনই বলব না। কারণ, আগের দিনে বলত যে পার্সেন্ট, এখন তার চেয়ে বেশি করা দরকার হয় সিজার। এখন তো কত রকমের প্রেগন্যান্সি হয়, বয়স্কদের হচ্ছে, কত অসুখ-বিসুখ।

আমার রোগী আমি নিজে মাদার কেয়ারে সিজার করেছি, ওভারিয়ান ক্যানসার। বিয়ের পরপরই, ছয় মাসের মধ্যে। আমার বড় বোনের নাতনি তখন থাকত কুয়েতে। ওখান থেকে ওর শাশুড়ি... ওনার ছেলে ছিল পাঁচটা, মেয়ে ছিল না। ওটাকে পালছিলেন। তো আমাকে ফোন করছে যে, ‘নানু, ওর তো কী নাকি হয়েছে?’ তো আমি বললাম, ‘পাঠিয়ে দাও’। দেখলাম যে ওভারিয়ান টিউমার। আরও আছে, এটা একটু বলি।

তখন ওটা অপারেশন করলাম, ওই মাদারকেয়ারেই করলাম। এরপর প্রায় তিন বছর চিকিৎসা করলাম। সব রকম কেমোথেরাপি, তা যা দিতে হয়, সবই দিছি। তারপর তিন বছর পরে দেখলাম যে সবকিছু ভালো, কোনো প্রবলেম নেই। আর আমি একটাই ওভারি ফেলছি। আর যত রকমের টেস্ট করার, করলাম। ওর যেটা হলো, তারপরে প্রেগন্যান্ট হলো নিজে নিজেই। একটা বাচ্চা আমার কাছে মাদার কেয়ারে হলো। আর সেকেন্ডটা, সে নিকুঞ্জ এখন থাকে, ওখানে কাকে দিয়ে করিয়েছে। তো সে জন্য বললাম, খারাপ কাজ করিনি।

প্রশ্ন

না, নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই। মানুষের দোয়া আপনার জন্য থাকবে।

শাহলা খাতুন: চেষ্টা করেছি।

প্রশ্ন

আর বিশেষ কিছু কি বলার আছে আপনার, যেটা...

শাহলা খাতুন: আমার জুনিয়রদের সম্বন্ধে বলব ধৈর্য ধরা শিখতে। তাড়াহুড়া না করতে। প্রত্যেক কিছুতে হোমওয়ার্ক করে আসতে। এরা হোমওয়ার্ক করার সময় পায় না, এটা আরেকটা অসুবিধা। আমি যেটা করি, হোমওয়ার্ক করি। সোজা কথা। আমি যদি ছয়টায় কোনো কেস করতে যাই, আমি পাঁচটার সময় বসে সেটা একবার দেখি। ওরা করে কী, পড়ালেখাও করবে চটি বই দিয়ে, আবার হোমওয়ার্কও করবে চটি বই দিয়ে। এটা বলি যে, বই পড়, বই পড়, ডাক্তারি ম্যাগাজিন পড়ো। অনেক খবর পাবে। ইভেন গুগল দেখো। কিন্তু তারা শোনে না। তারা খালি চটি বইটা পড়বে সারা জীবন আর টিক মারবে। কোনো কিছু মনে রাখতে পারে না। এটা কত বোঝাচ্ছি। প্র্যাকটিক্যালি তাদের অনেকে বুঝেছে এখন যে এতে আমার কোনো অসুবিধা নেই। হ্যাঁ, বইটা দরকার পরীক্ষার সময়। এর ফলে হচ্ছে কী, সব আবোল-তাবোল হয়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন

দর্শকমণ্ডলী, আমরা এতক্ষণ জাতীয় অধ্যাপক, স্ত্রী রোগবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এবং অধ্যাপনা করেছেন—বহু মানুষের চিকিৎসা করেছেন, বহু মানুষকে আলোকিত করেছেন এবং বাংলাদেশের স্বাস্থ্যে যিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন—ডাক্তার শাহলা খাতুনের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি আমাদের জাতীয় অধ্যাপক। তিনি বহু রোগীর সেবা করেছেন, মানুষের সেবা করেছেন এবং পড়িয়েছেন। বাংলাদেশকে আলোকিত করার পেছনে তাঁর অনেক অবদান আছে। তাঁর এই অভিজ্ঞতার আলো নিশ্চয়ই আমাদেরকে আলোকিত করবে। সামনের পথটাকে অনেক সুন্দর করবে। সবাই ভালো থাকবেন।