ধীরে চলা

২০ 

প্রতিটা সভাতেই কিছু মানুষ থাকে, যারা বক্তৃতা শোনে না, সম্মেলনকক্ষ ছেড়ে চলে যায় পাশের পানীয়ের কক্ষে। ভিনসেন্ট পতঙ্গবিদদের বক্তৃতা শুনতে শুনতে ভীষণ ক্লান্ত। তাঁর ভালো লাগেনি চেক বিজ্ঞানীর আজব কথাবার্তা। সে চলে এল পানকক্ষে। বারের পাশে লম্বা টেবিল। তারই মতো আরও কজন সম্মেলন ত্যাগ করে আসা মানুষ সেখানে বসে আছে। ভিনসেন্ট তাদের পাশে গিয়ে বসল।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সে পাশের এক অপরিচিত লোকের সঙ্গে আলাপ পাড়ল। ‘আমার এক বান্ধবী আছে, যে চায় আমি তার সঙ্গে রূঢ় আচরণ করি।’ পতেভিঁ যখন একই কথা বলেন, তখন তিনি একটা জায়গায় বিরতি দেন, একটা কথার ওপরে জোর দেন। ভিনসেন্ট চেষ্টা করল পতেভিঁর মতো করেই শব্দ প্রক্ষেপণের। তাতে বোধ হয় কাজও হলো। সকলে একযোগে হেসে উঠল। ভিনসেন্ট হাত তুলে সবাইকে বলল থামতে। তখন সে বুঝল, তার কথা শুনে কেউ হাসেনি। ঘরের আরেক পাশে দুজন ঝগড়া করছে। গালাগালি করছে। সবাই তাদের কাণ্ডে হাসছে।

এক মিনিট কি দুই মিনিট পরে সে আবার এমনভাবে কথা বলল, যাতে সবার কানে পৌঁছায়, আমি একটা গল্পের মধ্যে আছি, বলছিলাম কী, আমার একজন বান্ধবী আছে, সে চায় আমি তার সঙ্গে কর্কশ হই। সবাই তার কথা শুনছে। এবার সে আর বিরতি দেওয়ার ভুল করল না। টানা বলে যেতে লাগল, যাতে কেউ তার কথার ফাঁকে অন্য কিছু ঢুকিয়ে দিতে না পারে, ‘কিন্তু আমি তার কথা রাখতে পারি না। আমি তার সঙ্গে কর্কশ হতে পারি না। আমি তো একজন নরমশরম মানুষ।’ এরপর সে নিজেই হাসতে লাগল। তারপর দেখল, আর কেউই হাসছে না। এবার সে বলে যেতে লাগল, ‘একজন তরুণী আসে আমার কাছে, টাইপিস্ট, আমি বলি, ও লেখে।’

‘সে কি কম্পিউটার ব্যবহার করে?’ একজন দেখা গেল হঠাৎ করে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
‘হ্যাঁ’।
‘কোন কোম্পানির কম্পিউটার?’
ভিনসেন্ট একটা নির্মাতা কোম্পানির নাম বলল।

লোকটা বলল, তার কম্পিউটার অন্য ব্রান্ডের। সে তার নিজের কম্পিউটারের গল্প করতে লাগল। কম্পিউটার কোম্পানিটা ভালো নয়। তাদের সার্ভিস ভালো নয়। লোক ঠকিয়ে খায়।

ভিনসেন্ট লক্ষ করল, সবাই এর কথাই শুনছে। হাসছে। মাঝেমধ্যে হাসির হররা উঠছে।

ভিনসেন্ট তখন মন খারাপ করে ভাবতে লাগল তার একটা পুরোনো ভাবনা। লোকে ভাবে, একটা লোকের ভাগ্য তার চেহারার ওপরে নির্ভর করে, লোকটা দেখতে ভালো না খারাপ, তার আকার কেমন, মাথায় চুল আছে নাকি নেই। কিন্তু এই ধারণা ভুল। একজন মানুষের ভাগ্য নির্ভর করে আসলে তার কণ্ঠস্বরের ওপরে। ভিনসেন্টের নিজের গলা দুর্বল, মনে হয় ধূর্ত। যখন সে কথা বলতে শুরু করে, কেউ তাকে পাত্তা দেয় না। যখন সে গলা চড়ায়, তখন মনে হয়, লোকটা চেঁচাচ্ছে কেন? বিপরীতে, পতেভিঁর গলা ভারী, তিনি যখন অনুচ্চ কণ্ঠে কথা বলেন, মৃদুভাবে, তখনো তা শোনায় সুন্দর, শক্তিমান, প্রীতিকর। সবাই তার কথা শোনে।

আহ, বেচারি পতেভিঁ। তিনি ভিনসেন্টের সঙ্গে সদলবলে আসতে চেয়েছিলেন এই সম্মেলনে। কিন্তু তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। এটাই তার স্বভাব। কাজের চেয়ে কথা বেশি। ভিনসেন্ট আশাহত হয়েছিল। তবে একটা বিষয়ে সে পতেভিঁর ওপরে খুশি। আরও বেশি অনুগত বোধ করছে। তা হলো, ভিনসেন্টের যাত্রার প্রাক্কালে পতেভিঁ তাকে বলে দিয়েছিলেন, ‘শোনো, তুমি কিন্তু আমাদের সবার পক্ষ থেকে যাচ্ছ, তুমি আমাদের সবার প্রতিনিধি। যাও। তোমাকে আমি পূর্ণ ক্ষমতা দিচ্ছি, আমাদের নামে, আমাদের স্বার্থে তুমি ওখানে যেকোনো কিছু করার অধিকার পাচ্ছ।’

ভিনসেন্ট জানে, এই কথা ছিল একটা কৌতুক মাত্র। কিন্তু বন্ধুদের এই দলের সবাই জানে, এই যে অর্থহীন পৃথিবী, এখানে কেবল কৌতুক করে বলা আদেশই পালন করা উচিত। মাচু হাসছিল। সে পতেভিঁর কথায় সায় দিচ্ছিল। এখন এই সেমিনার রুমের পাশের ঘরে বসে ভিনসেন্টের মনে পড়ল সেই হাসিমুখ অনুমোদনের কথা। তাহলে তার এখন একটা কিছু করা উচিত। ঠিক এই সময়ে তার চোখ পড়ল এক তরুণীর ওপরে, যাকে সে খুবই পছন্দ করে।
(চলবে)

আরও পড়ুন: