ধীরে চলা

২৩

যখন, এক ঘণ্টা আগে, বার্ক ইমাকুলাতাকে দেখতে পেয়েছিলেন, তখন তাঁর মনে হয়েছিল যে তিনি চিৎকার করে উঠবেন। কিন্তু এখন এই চেক বিজ্ঞানী যে বিরক্তি উৎপাদন করেছেন, তা ইমাকুলাতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এই মহিলা তাকে চেক বিজ্ঞানীটির জ্ঞানের অত্যাচার থেকে মুক্তি দিয়েছে, সে জন্য তিনি কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে একপ্রস্থ হাসিও উপহার দিলেন।
খুশি হয়ে ইমাকুলাতা হাসিমুখে, দৃশ্যত, পরিচিত গলায় বলে, ‘জ্যাক অ্যালাইঁ বার্ক, এখানে এই পতঙ্গবিদদের সমাবেশে, নিয়তির নির্দেশে, একটু আগে আপনি একটা খুবই আবেগপূর্ণ এক মুহূর্ত পাড়ি দিলেন...’
মেয়েটি তার মাইক্রোফোন এগিয়ে দেয় বার্কের মুখের সামনে।
বার্ক স্কুলবালকের মতো জবাব দিতে থাকেন, ‘আমাদের সৌভাগ্য হয়েছে এখানে একজন চেক বিজ্ঞানীকে স্বাগত জানানোর, যিনি কিনা তাঁর পতঙ্গবিদের পেশার সাধনা ছেড়ে দিয়ে বাধ্য হয়েছিলেন সারাটা জীবন কারাগারে কাটাতে! আমরা সবাই তার উপস্থিতি আবেগে আপ্লুত।’
একজন নাচিয়ে হওয়া কেবল একটা আবেগের ব্যাপার নয়, এটা হলো এমন একটা পথ বেছে নেওয়া, যেখান থেকে আর কখনো ফিরে আসা যায় না। দুবিউক তাঁকে হারিয়ে দিয়েছিল এইডস রোগীদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজের সময়। বার্ক যে সোমালিয়ায় গিয়েছিলেন, তা তো মানুষের কল্যাণ করতে নয়, বরং নাচের একটা ভুল মুদ্রা ঢাকার প্রয়াসে তিনি সেখানে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। এখন তাঁর মনে হচ্ছে তাঁর মন্তব্য যথেষ্ট সুন্দর হয়নি। কী যেন কম পড়ল! একটুখানি লবণ দরকার। তিনি কথা বলেই চলেন। একটু দূরে দেখতে পান একটা অনুপ্রেরণা হেঁটে আসছে তাঁরই দিকে, তিনি বলে ফেলেন, ‘আমি এই সুযোগটাকে কাজে লাগাতে চাই, আমার প্রস্তাব হলো আমরা একটা ফরাসি-চেক কীটতত্ত্ববিদ অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করব।’(হঠাৎ করে আসা এই ভাবনা তাঁর নিজেকেই বিস্মিত করল, এখন তাঁর বেশ ভালো বোধ হচ্ছে)। আমি একটু আগে এই আইডিয়া আমার প্রাগ থেকে আসা সহকর্মীর সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছি। (তিনি চেক বিজ্ঞানীর দিকে ইঙ্গিত করলেন।) তিনি আমার এই আইডিয়াটাকে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। বলেছেন, এই অ্যাসোসিয়েশনের নামকরণ করা হবে মিকিউজের নাম অনুসারে। মহান নির্বাসিত কবি আদাম মিকিউজ। আমাদের দুই দেশের জনগণের বন্ধুত্বের প্রতীক একটি নাম। এই নাম আমাদের সব সময় শিক্ষা দেবে, আমরা যা–ই করি না কেন, বিজ্ঞান কিংবা কবিতা, তা একটা বিদ্রোহের কাজ মাত্র। (বিদ্রোহ কথাটা তাকে কথা বলার স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিল। গরু নদীতে পড়েছে। এবার নৌকাভ্রমণ নিয়ে বলা যাবে!) বিদ্রোহ! প্রতিটা মানুষ সারাক্ষণই বিদ্রোহের মধ্যে আছে। তা–ই কি নয়, বন্ধু আমার? (তিনি চেক বিজ্ঞানীর দিকে তাকালেন, বিজ্ঞানী মাথা ঝাঁকালেন, যার মানে, ‘হ্যাঁ। অবশ্যই।’) আপনি এটা প্রমাণ করেছেন আপনার জীবন দিয়ে। আপনার ত্যাগ দিয়ে। নির্যাতন ভোগের মধ্য দিয়ে। আপনি আমার এই বিশ্বাসকে জোরদার করেছেন যে মানুষ আসলে নিজেকে যোগ্য করে তোলে সর্বদা বিদ্রোহ করার মধ্য দিয়ে। শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। যেদিন শোষণ থাকবে না...(তিনি একটা বড় বিরতি নিলেন। পতেভিঁই আর একজন মাত্র ব্যক্তি, যিনি এত বড় বিরতি নিতে পারেন সার্থকতার সঙ্গে, তারপর একটু নিচু স্বরে তিনি বলে চলেন)...মানুষের যে অবস্থা আমরা বেছে নিইনি তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।

মানুষের যে অবস্থা আমরা বেছে নিইনি তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ! এটা ছিল তার শেষ বাক্য। এটা তিনি বানিয়ে বললেন। একটা ফুল ফোটালেন। এটা তার নিজেকেই মুগ্ধ করছে। এত সুন্দর একটা লাইন। সত্যিই সুন্দর। রাজনীতিকদের রোজকার ভাষণের চেয়ে কত আলাদা! এই দেশের সবচেয়ে ভালো চিন্তাবিদদের স্তরে এই লাইনটা তাঁকে উন্নীত করল। কামু হয়তো এমন কথা লিখতে পারতেন। মার্লো। কিংবা পারতেন সার্ত্রে।
দারুণ। ইমাকুলাতা ইশারা করল। ক্যামেরা বন্ধ হলো।
চেক বিজ্ঞানী এগিয়ে আসেন। বার্ককে বলেন, ‘খুব সুন্দর। খুবই সুন্দর। কিন্তু একটা কথা না বললেই নয়। মিকিউইজ মোটেই চেক ছিলেন না।’
এই ধরনের একটা পাবলিক পারফরমেন্সের পর, উন্মুক্ত প্রদর্শনী শেষে, বার্ক একজন মাতালের মতো ঘোরগ্রস্ত থাকেন, তাঁর কণ্ঠস্বর থাকে দৃঢ়, বিদ্রূপাত্মক, উঁচু; চেক বিজ্ঞানীকে বাধা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি জানি, আমি জানি, যেমন আমি জানি, মিকিউজ একজন কীটতত্ত্ববিদও ছিলেন না, সাধারণত কোনো কবিই কীটতত্ত্ববিদ হন না, তবুও তারা সবাই এই মানবপ্রজাতিরই গর্ব। তেমনি ভাবে আপনারা, কীটতত্ত্ববিদেরা, এমনকি আপনিও, সমস্ত মানবজাতির গৌরব।’
একটা বিশাল হাসির হররা ওঠে। পিচকিরির মতো করে। এতক্ষণ যা চাপা পড়েছিল। এই পতঙ্গবিদেরা হাসার জন্য মারা যাচ্ছিল। কিন্তু হাসতে পারছিল না। চেক বিজ্ঞানী এতটাই আবেগাপ্লুত যে তাঁর পেপার পড়তেই ভুলে গেছেন। এখন বার্কের দুর্বিনীত মন্তব্য তাঁদের ভদ্রতার লাগাম থেকে মুক্তি দিয়েছে, তারা এখন হাসির হুল্লোড় তুলেছেন মনের আনন্দে।
চেক বিজ্ঞানী দুর্ভাবনায় পড়েন। দশ মিনিট আগে যাঁরা তাকে কত শ্রদ্ধাই না দেখালেন, তাঁরা এখন এইভাবে হাসছেন কেন? এটা কী করে সম্ভব যে তারা হাসতে পারছেন? নিজেদের অনুমতি দিচ্ছেন হাসার জন্য? মানুষ এত তাড়াতাড়ি করে শ্রদ্ধা থেকে সরে গিয়ে অবজ্ঞা প্রদর্শন করতে পারে? (হ্যাঁ। পারে। বন্ধুরা, পারে)। তাহলে কি শুভবোধ এতটাই ভঙ্গুর, এতটাই নাজুক? (হ্যাঁ। বন্ধুরা। তা-ই সত্য)
এই সময় এগিয়ে আসে ইমাকুলাতা। বার্ককে সে সজোরে আর মাদকতাময় কণ্ঠে বলে, ‘বার্ক। বার্ক। অপূর্ব। চমৎকার। উফ্‌। এত সুন্দর করে কেবল তুমিই বলতে পারো। তোমার এই পরিহাসকে আমি পছন্দ করি। তুমি নিশ্চয়ই আমার ওপরেও এটাই প্রয়োগ করেছিলে! স্কুলের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে তোমার! বার্ক। বার্ক। তুমি আমার নাম দিয়েছিল ইমাকুলাতা, যার মানে দাগহীন। রাতের পাখি তোমার ঘুম নষ্ট করত। তোমার স্বপ্নকে চৌচির করত। আমরা দুজনে মিলে একটা ফিল্ম বানাব। তোমার ওপরে একটা ছবি। তুমি নিশ্চয়ই স্বীকার করবে এমন একটা সিনেমা বানানোর অধিকার কেবল আমারই আছে।’
চেক বিজ্ঞানীকে তিনি যেভাবে ধরাশায়ী করেছেন, তার ফলে কীটতত্ত্ববিদেরা যে হাসি দিয়েছে, তার প্রতিধ্বনি এখনো রয়ে গেছে বার্কের মস্তিষ্কে। তাঁকে দূষিত করে রেখেছে সেই তাজা অনুভূতি। আত্মতৃপ্তি। এসব মুহূর্তে তিনি এমন খোলামেলা আচরণ করে বসেন, যাকে তিনি নিজেই অনেক সময় ভয় পান। তাই এরপর তিনি যা করবেন, তাঁকে আমাদের আগাম ক্ষমা করে রাখতে হবে। তিনি ইমাকুলাতার ডানা ধরে তাকে একপাশে নিয়ে গেলেন, তারপর অন্যদের কানের আড়ালে নিয়ে গিয়ে মেয়েটির ফুটোওয়ালা কানে বলতে লাগলেন, ‘যাও। গো ফাক ইয়োরসেল্ফ। বুড়ি বেশ্যা। তোমার অসুস্থ পড়শিনী। গো ফাক ইয়োরসেলফ। রাতের পাখি। রাতের কাক। দুঃস্বপ্ন। আমাকে আমার বোকামো মনে করিয়ে দাও? আমার গাধামোর মিনার দেখাও? আমার স্মৃতির নর্দমা বয়ে আনো? আমার তারুণ্যের গন্ধ নিয়ে আসো।’
ইমাকুলাতা শোনে। বিশ্বাস করতে পারে না সে যা শুনছে তা সে শুনছে কিনা। সে ভাবে, এই লোক এসব বলছেন কাউকে শুনিয়ে শুনিয়ে কারও কাছে কিছু একটা আড়াল করার জন্য। নিজের অতীতকে ঢাকার জন্য। কাউকে তিনি বোকা বানাতে চাইছেন। আসলে তিনি এসব তাকে বলছেন না, তৃতীয় কাউকে বলছেন শুধু একটা কৌশল হিসেবে।
সুতরাং কোনো রকম প্রতিক্রিয়া ছাড়াই নরম কণ্ঠে সে শুধায়, ‘তুমি কেন এসব আমাকে বলছ। কেন? আমি এসব কীভাবে নেব?’
‘তুমি এসব নেবে একেবারে এ কথাগুলোর যা মানে আছে তা সমেত। আক্ষরিকভাবে। পুরোই আক্ষরিক অর্থে। বেশ্যা মানে বেশ্যা। গুহ্যদ্বারে ব্যথা মানে গুহ্যদ্বারে ব্যথা। দুঃস্বপ্ন মানে দুঃস্বপ্ন। ভাগো মানে ভাগো।’
(চলবে)

আরও পড়ুন: